সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । সিন্ধু হিন্দোল কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা রয়েছে। কাব্যগ্রন্থটি “বাহার ও নাহার”-কে (হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শামসুন নাহার) উৎসর্গ করেন।

সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ কবিতা
হে ক্ষুধিত বন্ধু মোর, তৃষিত জলধি, এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষার অবধি! এত নদী উপনদী তব পদে করে আত্মদান, বুভুক্ষু! তবু কিতব ভরলি না প্রাণ? দুরন্ত গো, মহাবাহু ওগো রাহু, তিন ভাগগ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকী! সুরা নাই-পাত্র-হাতে কাঁপিতেছে সাকী! হে দুর্গম! খোলো খোলো খোলো দ্বার। সারি সারি গিরি-দরী দাঁড়ায়ে দুয়ারে করে প্রতীক্ষাতোমার। শস্য-শ্যামা বসুমতী ফুলে-ফলে ভরিয়া অঞ্জলি করিছে বন্দনা তব, বলী! তুমি আছ নিয়া নিজ দুরন্ত কল্লোল আপনাতে আপনি বিভোল! পাশে নাশ্রবণে তব ধরণীতে শত দুঃখ-গীত; দেখিতেছ বর্তমান, দেখেছ অতীত, দেখিবে সুদূর ভবিষ্যৎ- মৃত্যুঞ্জয়ী দ্রষ্টা, ঋষি, উদাসীনবৎ! ওঠে ভাঙে তব বুকে তরঙ্গেরমতো জন্ম-মৃত্যু দুঃখ-সুখ, ভূমানন্দে হেরিছ সতত! হে পবিত্র! আজিও সুন্দর ধরা, আজিও অম্লান সদ্য-ফোটা পুষ্পসম, তোমাতে করিয়ানিতি স্নান! জগতের যত পাপ গ্লানি হে দরদী, নিঃশেষে মুছিয়া লয় তবস্নেহ-পাণি! ধরা তব আদরিনী মেয়ে, তাহারে দেখিতে তুমি আস’ মেঘ বেয়ে! হেসে ওঠে তৃণে-শস্যে দুলালী তোমার, কালো চোখ বেয়ে ঝরে হিম-কণাআনন্দাশ্রু-ভরা! জলধারা হ’য়ে নামো, দাও কত রঙিন যৌতুক, ভাঙ’ গড়’ দোলাদাও,- কন্যারে লইয়া তব অনন্ত কৌতুক!
হে বিরাট, নাহি তব ক্ষয়, নিত্য নবনব দানে ক্ষয়েরে ক’রেছ তুমি জয়! হে সুন্দর! জলবাহু দিয়া ধরণীর কটিতট আছো আঁকড়িয়া ইন্দ্রানীলকান্তমণিমেখলার সম, মেদিনীর নিতম্ব সাথে দোল’ অনুপম! বন্ধু, তব অনন্তযৌবন তরঙ্গে ফেনায়ে ওঠে সুরার মতন! কত মৎস্য-কুমারীরা নিত্য তোমা’ যাচে, কত জল-দেবীদের শুষ্ক মালা প’ড়ে তব চরণের কাছে, চেয়ে নাহি দেখ, উদাসীন! কার যেন স্বপ্নে তুমি মত্ত নিশিদিন! মন্থর-মন্দার দিয়া দস্যুসুরাসুর মথিয়া লুন্ঠিয়া গেছে তব রত্ন-পুর, হরিয়াছে উচ্চেঃশ্রবা, তব লক্ষ্মী, তব শশী-প্রিয়া তার সব আছে আজ সুখে স্বর্গে গিয়া! করেছে লুন্ঠন তোমার অমৃত-সুধা-তোমার জীবন! সব গেছে, আছে শুধু ক্রন্দন-কল্লোল, আছে জ্বালা, আছেস্মৃতি, ব্যথা-উতরোল উর্ধ্বে শূন্য, নিম্নে শূন্য,-শূন্য চারিধার, মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার! হে মহান! হে চির-বিরহী! হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে মোরবিদ্রোহী, সুন্দর আমার! নমস্কার! নমস্কার লহ! তুমি কাঁদ,-আমিকাঁদি,-কাঁদে মোর প্রিয়া অহরহ। হে দুস্তর, আছে তব পার, আছে কূল, এ অনন্তবিরহের নাহি পার–নাহি কূল–শুধু স্বপ্ন, ভুল। মাগিব বিদায় যবে, নাহি র’বআর, তব কল্লোলের মাঝে বাজে যেন ক্রন্দন আমার! বৃথাই খুঁজিবে যবেপ্রিয় উত্তরিও বন্ধু ওগো সিন্ধু মোর, তুমি গরজিয়া! তুমি শূন্য, আমি শূন্য, শূন্য চারিধার, মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার।

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ
- গোপন প্রিয়া
- অনামিকা
- বিদায় স্মরণে
- পথের স্মৃতি
- উন্মনা
- অতল পথের যাত্রী
- দারিদ্র্য
- বাসন্তি
- ফাল্গুনী
- মঙ্গলাচরণ
- বধু-বরণ
- অভিযান
- রাখী-বন্ধন
- চাঁদনী-রাতে
- মাধবী-প্রলাপ
- দ্বারে বাজে ঝঞ্জার জিঞ্জির