শীতের সিন্ধু কবিতা । চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম

শীতের সিন্ধু কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে ।  চক্রবাক  কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ১৯টি। এই কাব্যে নজরুল বেদনার ছবি তুুুলে ধরেছেন; এতে রয়েছে প্রেমের অনুুুভূতি এবং অতীত সুুখের স্মৃতিচারণা।

 

শীতের সিন্ধু কবিতা । চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম [ Kazi nazrul islam ]

শীতের সিন্ধু কবিতা

ভুলি নাই পুনঃ তাই আসিয়াছি ফিরে
ওগো বন্ধু, ওগো প্রিয়, তব সেই তীরে!
কূল-হারা কূলে তব নিমেষের লাগি
খেলিতে আসিয়া হায় যে কবি বিবাগি
সকলই হারায়ে গেল তব বালুচরে, –
ঝিনুক কুড়াতে এসে – গেল আঁখি ভরে
তব লোনা জল লয়ে, –তব স্রোত-টানে
ভাসিয়া যে গেল দূর নিরুদ্দেশে পানে!
ফিরে সে এসেছে আজ বহু বর্ষ পরে,
চিনিতে পার কি বন্ধু, মনে তারে পড়ে?

বর্ষার জোয়ারে যারে তব হিন্দোলায়
দোলাইয়া ফেলে দিলে দুরাশা-সীমায়,
ফিরিয়া সে আসিয়াছে তব ভাটি-মুখে,
টানিয়া লবে কি আজ তারে তব বুকে?

খেলিতে আসিনি বন্ধু, এসেছি এবার
দেখিতে তোমার রূপ বিরহ-বিথার।
সেবার আসিয়াছিনু হয়ে কুতূহলী,
বলিতে আসিয়া – দিনু আপনারে বলি

কৃপণের সম আজ আসিয়াছি ফিরে
হারায়েছি মণি যথা সেই সিন্ধু-তীরে!
ফেরে না তা যা হারায় – মণি-হারা ফণী
তবু ফিরে ফিরে আসে! বন্ধু গো, তেমনি
হয়তো এসেছি বৃথা চোর বালুচরে!–
যে চিতা জ্বলিয়া, –যায় নিভে চিরতরে,
পোড়া মানুষের মন সে মহাশ্মাশানে
তবু ঘুরে মরে কেন, –কেন সে কে জানে!
প্রভাতে ঢাকিয়া আসি কবরের তলে
তারি লাগি আধ-রাতে অভিসারে চলে
অবুঝ মানুষ, হায়! – ওগো উদাসীন,
সে বেদনা বুঝবে না তুমি কোনোদিন!

হয়তো হারানো মণি ফিরে তারা পায়,
কিন্তু হায়, যে অভাগা হৃদয় হারায়
হারায়ে সে চিরতরে! এ জনমে তার
দিশা নাহি মিলে, বন্ধু! – তুমি পারাবার,
পারাপার নাহি তব, তোমার অতলে
যা ডোবে তা চিরতরে ডোবে আঁখিজলে!‌
জানিলে সাঁতার, বন্ধু, হইলে ডুবুরি,
করিতাম কবে তব বক্ষ হতে চুরি
রত্নহার! কিন্তু হায় জিনে শুধু মালা
কী হইবে বাড়াইয়া হৃদয়ের জ্বালা!
বন্ধু, তব রত্নহার মোর তরে নয় –
মালার সহিত যদি না মেলে হৃদয়!

 

হে উদাসী বন্ধু মোর, চির আত্মভোলা,
আজি নাই বুকে তব বর্ষার হিন্দোলা!
শীতের কুহেলি-ঢাকা বিষণ্ণ বয়ানে
কীসের করুণা মাখা! কূলের সিথানে
এলায়ে শিথিল দেহ আছ একা শুয়ে,
বিশীর্ণ কপোল বালু-উপাধানে থুয়ে!
তোমার কলঙ্কী বঁধু চাঁদ ডুবে যায়
তেমনই উঠিয়া দূর গগন-সীমায়,
ছায়া এসে পড়ে তার তোমার মুকুরে,
কায়াহীন মায়াবীর মায়া বুকে পূরে
ফুলে ফুলে কূলে কূলে কাঁদ অভিমানে,
আছাড়ি তরঙ্গ-বাহু ব্যর্থ শূন্য পানে!
যে কলঙ্কী নিশিদিন ধায় শূন্য পথে –
সে দেখে না, কোথা, কোন বাতায়ন হতে,
কে তারে চাহিয়াছে নিতি! সে খুঁজে বেড়ায়
বুকের প্রিয়ারে ত্যজি পথের প্রিয়ায়!

ভয় নাই বন্ধু ওগো, আসিনি জানিতে
অন্ত তব, পেতে ঠাঁই অন্তহীন চিতে!
চাঁদ না সে চিতা জ্বলে তব উপকূলে –
কে কবে ডুবিয়া হায়, পাইয়াছে তল?
এক ভাগ থল সেথা, তিন ভাগ জল!

এসেছি দেখিতে তারে সেদিন বর্ষায়
খেলিতে দেখেছি যারে উদ্দাম লীলায়
বিচিত্র তরঙ্গ-ভঙ্গে! সেদিন শ্রাবণে
ছলছল জল-চুড়ি-বলয়-কঙ্কণে
শুনিয়াছি যে-সঙ্গীত, যার তালে তালে
নেচেছে বিজলি মেঘে, শিখী নীপ-ডালে।
যার লোভে অতি দূর অস্তদেশ হতে
ছুটে এসেছিনু এই উদয়ের পথে! –

ওগো মোর লীলা-সাথি অতীত বর্ষার,
আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার!
চলে গেছে আজি সেই বরষার মেঘ,
আকাশের চোখে নাই অশ্রুর উদ‍্‍বেগ,
গরজে না গুর গুর গগনে সে বাজ,
উড়ে গেছে দূর বনে ময়ূরীরা আজ,
রোয়ে রোয়ে বহে নাকো পুবালি বাতাস,
শ্বসে না ঝাউয়ের শাখে সেই দীর্ঘশ্বাস,
নাই সেই চেয়ে-থাকা বাতায়ন খুলি
সেই পথে – মেঘ যথা যায় পথ ভুলি।
না মানিয়া কাজলের ছলনা নিষেধ
চোখ ছেপে জল ঝরা, –কপোলের স্বেদ
মুছিবার ছলে আঁখি-জল মোছা সেই,
নেই বন্ধু, আজি তার স্মৃতিও সে নেই!

থর থর কাঁপে আজ শীতের বাতাস,
সেদিন আশার ছিল যে দীরঘ-শ্বাস –
আজ তাহা নিরাশায় কেঁদে বলে, হায় –
“ওরে মূঢ়, যে চায় সে চিরতরে যায়!
যাহারে রাখিবি তুই অন্তরের তলে
সে যদি হারায় কভু সাগরের জলে
কে তাহারে ফিরে পায়? নাই, ওরে নাই,
অকূলের কূলে তারে খুঁজিস বৃথাই!
যে-ফুল ফোটেনি ওরে তোর উপবনে
পুবালি হাওয়ার শ্বাসে বরষা-কাঁদনে,
সে ফুল ফুটিবে না রে আজ শীত-রাতে
দু ফোঁটা শিশির আর অশ্রুজল-পাতে!”

আমার সান্ত্বনা নাই জানি বন্ধু জানি,
শুনিতে এসেছি তবু – যদি কানাকানি
হয় তব কূলে কূলে আমার সে ডাক!

এ কূলে বিরহ-রাতে কাঁদে চক্রবাক,
ও কূলে শোনে কি তাহা চক্রবাকী তার?
এ বিরহ একি শুধু বিরহ একার?

কুহেলি-গুণ্ঠন টানি শীতের নিশীথে
ঘুমাও একাকী যবে, নিশব্দ সংগীতে
ভরে ওঠে দশ দিক, সে নিশীথে জাগি
ব্যথিয়া ওঠে না বুক কভু কাও লাগি?
গুণ্ঠন খুলিয়া কভু সেই আধরাতে
ফিরিয়া চাহ না তব কূলে কল্পনাতে?
চাঁদ সে তো আকাশের, এই ধরা-কূলে
যে চাহে তোমায় তারে চাহ না কি ভুলে?

 

তব তীরে অগস্ত্যের সম লয়ে তৃষা
বসে আছি, চলে যায় কত দিবা-নিশা!
যাহারে করিতে পারি চুমুকেতে পান
তার পদতলে বসি গাহি শুধু গান!
জানি বন্ধু, এ ধরার মৃৎপাত্রখানি
ভরিতে নারিল যাহা – তারে আমি আনি
ধরিব না এ অধরে! এ মম হিয়ার
বিপুল শূন্যতা তাহে নহে ভরিবার!
আসিয়াছি কূলে আজ, কাল প্রাতে ঝুরে
কূল ছাড়ি চলে যাব দূরে বহুদূরে।

বলো বন্ধু, বলো, জয় বেদনার জয়!
যে-বিরহে কূলে কূলে নাহি পরিচয়,
কেবলই অনন্ত জল অনন্ত বিচ্ছেদ,
হৃদয় কেবলই হানে হৃদয়ে নিষেধ ;
যে-বিরহে গ্রহ-তারা শূন্যে নিশিদিন
ঘুরে মরে ; গৃহবাসী হয়ে উদাসীন –
উল্কা-সম ছুটে যায় অসীমের পথে,
ছোটে নদী দিশাহারা গিরিচূড়া হতে ;
বারে বারে ফোটে ফুল কণ্টক-শাখায়,
বারে বারে ছিঁড়ে যায় তবু না ফুরায়
মালা-গাঁথা যে-বিরহে, যে-বিরহে জাগে
চকোরী আকাশে আর কুমুদী তড়াগে ;

তব বুকে লাগে নিতি জোয়ারের টান,
যে-বিষ পিইয়া কণ্ঠে ফুটে ওঠে গান –
বন্ধু, তার জয় হোক! এই দুঃখ চাহি
হয়তো আসিব পুনঃ তব কূল বাহি।
হেরিব নতুন রূপে তোমারে আবার,
গাহিব নতুন গান। নব অশ্রুহার
গাঁথিব গোপনে বসি। নয়নের ঝারি
বোঝাই করিয়া দিব তব তীরে ডারি।
হয়তো বসন্তে পুনঃ তব তীরে তীরে
ফুটিবে মঞ্জরি নব শুষ্ক তরু-শিরে।
আসিবে নতুন পাখি শুনাইতে গীতি,
আসিবে নতুন পাখি শুনাইতে গীতি,

যেদিন ও বুকে তব শুকাইবে জল,
নিদারুণ রৌদ্র-দাহে ধুধু মরুতল
পুড়িবে একাকী তুমি মরূদ্যান হয়ে
আসবি সেদিন বন্ধু, মম প্রেম লয়ে!
আঁখির দিগন্তে মোর কুহেলি ঘনায়,
বিদায়ের বংশী বাজে, বন্ধু গো বিদায়!

শীতের সিন্ধু কবিতা । চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম [ Kazi nazrul islam ]

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।

১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্‌-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

 

শীতের সিন্ধু কবিতা । চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম

 

চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ

 

 

Leave a Comment