ওমর খৈয়াম – রুবাইয়াত্-ই-ওমর : গ্রন্থটি ইরানের জীবনবাদী কবি ওমর খৈয়ামের “রুবাই” বা “কবিতা” অবলম্বনে রচিত। ওমর খৈয়াম আমাদের একাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে খোরাসানের নাইশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং আমাদের দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম চতুর্থাংশের মধ্যে মারা যান। এই অনুবাদগ্রন্থ রচনা করেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে, রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ওমর খৈয়াম এর জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নজরুলকে খুব আলোড়িত করেছিলেন।। এ অনুবাদে অত্যন্ত চমৎকার ভাষাভঙ্গি ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যান্য অনুবাদকর্মের চেয়ে নজরুলের অনুবাদ অনুভূতির পরশে, যথাযথ শব্দের পারিপাট্যে উজ্জ্বল।
আর্থার ক্রিস্টেনসেন বলেছেন যে “ওমরের নামে ১,২০০ টিরও বেশি রুবাই পচলিত, তবে শুধুমাত্র ১২১ টি যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রামাণিক হিসাবে বিবেচিত হতে পারে”। ফরৌঘি ১৭৮ টি কোয়াট্রেনকে প্রামাণিক হিসাবে গ্রহণ করেছেন, যেখানে আলী দাশতি তাদের মধ্যে ৩৬ টি গ্রহণ করেছেন।
![রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম | অনুবাদ । কাজী নজরুল ইসলাম 3 ওমর খৈয়াম [ Omar Khayyám ]](http://amarnazrul.com/wp-content/uploads/2022/04/Omar-Khayyam-Rubaiyat-Painting-23-206x300.jpg)
Table of Contents
ওমর খৈয়াম – রুবাইয়াত্-ই-ওমর
রুবাই ১
রাতের আঁচল দীর্ণ করে আসল শুভ ওই প্রভাত,
জাগো সাকি! সকাল বেলার খোয়ারি ভাঙো আমার সাথ।
ভোলো ভোলো বিষাদ-স্মৃতি! এমনি প্রভাত আসবে ঢের,
খুঁজতে মোদের এইখানে ফের, করবে করুণ নয়নপাত।

রুবাই ২
আঁধার অন্তরীক্ষে বুনে যখন রুপার পাড় প্রভাত,
পাখির বিলাপ-ধ্বনি কেন শুনি তখন অকস্মাৎ?
তারা যেন দেখতে বলে উজল প্রাতের আরশিতে–
ছন্নছাড়া তোর জীবনের কাটল কেমন একটি রাত!

রুবাই ৩
‘ঘুমিয়ে কেন জীবন কাটাস?’ কইল ঋষি স্বপ্নে মোর,
‘আনন্দ-গুল প্রস্ফুটিত করতে পারে ঘুম কি তোর?
ঘুম মৃত্যুর যমজ-ভ্রাতা, তার সাথে ভাব করিসনে,
ঘুম দিতে ঢের পাবি সময় কবরে তোর জনম-ভোর।’

রুবাই ৪
আমার আজের রাতের খোরাক তোর টুকটুক শিরীন ঠোঁট
গজল শোনাও, শিরাজি দাও, তন্বী সাকি জেগে ওঠ!
লাজ-রাঙা তোর গালের মত দে গোলাপি-রং শরাব,
মনে ব্যথার বিনুনি মোর খোঁপায় যেমন তোর চুনোট।

রুবাই ৫
প্রভাত হল। শরাব দিয়ে করব সতেজ হৃদয়-পুর,
যশোখ্যাতির ঠুনকো এ কাচ করব ভেঙে চাখনাচুর।
অনেক দিনের সাধ আশা এক নিমেষে করব ত্যাগ,
পরব প্রিয়ার বেণি বাঁধন, ধরব বেণুর বিধুর সুর।

রুবাই ৬
ওঠো নাচো! আমরা প্রচুর করব তারিফ মদ-অলস
ওই নার্গিস আঁখির তোমার, ঢালবে তুমি আঙুর-রস!
এমন কী আর – যদিই তাহা পান করি দশ বিশ গেলাস,
ছয় দশে ষাট পাত্র পড়লে খানিকটা হয় দিল্ সরস!

রুবাই ৭
তোমার রাঙা ঠোঁটে আছে অমৃত-কূপ প্রাণ-সুধার,
ওই পিয়ালার ঠোঁট যেন গো ছোঁয় না, প্রিয়া, ঠোঁট তোমার।
ওই পিয়ালার রক্ত যদি পান না করি, শাপ দিয়ো;
তোমার অধর স্পর্শ করে এত বড়ো স্পর্ধা তার!

রুবাই ৮
আজকে তোমার গোলাপ-বাগে ফুটল যখন রঙিন গুল
রেখো না পান পাত্র বেকার, উপচে পড়ুক সুখ ফজুল।
পান করে নে, সময় ভীষণ অবিশ্বাসী, শত্রু ঘোর,
হয়তো এমন ফুল-মাখানো দিন পাবি না আজের তুল!

রুবাই ৯
শরাব আনো! বক্ষে আমার খুশির তুফান দেয় যে দোল।
স্বপ্ন-চপল ভাগ্যলক্ষ্মী জাগল জাগো ঘুম-বিভোল!
মোদের শুভদিন চলে যায় পারদ-সম ব্যস্ত পায়
যৌবনের এই বহ্নি নিভে খোঁজে নদীর শীতল কোল।

রুবাই ১০
আমরা পথিক ধূলির পথের, ভ্রমি শুধু একটি দিন,
লাভের অঙ্ক হিসাব করে পাই শুধু দুখ, মুখ মলিন।
খুঁজতে গিয়ে এই জীবনে রহস্যেরই কূল বৃথাই
অপূর্ণ সাধ আশা লয়ে হবই মৃত্যুর অঙ্কলীন।

রুবাই ১১
ধরায় প্রথম এলাম নিয়ে বিস্ময় আর কৌতূহল,
তারপর – এ জীবন দেখি কল্পনা, আঁধার অতল।
ইচ্ছা থাক কি না থাক, শেষে যেতেই হবে, তাই বলি–
এই যে জীবন আসা-যাওয়া আঁধার ধাঁধার জট কেবল!

রুবাই ১২
রহস্য শোন সেই সে লোকের আত্মা যথায় বিরাজে,
ওরে মানব! নিখিল সৃষ্টি লুকিয়ে আছে তোর মাঝে।
তুই-ই মানুষ, তুই-ই পশু, দেব্তা দানব স্বর্গদূত,
যখন হতে চাইবি রে যা হতে পারিস তুই তা যে।

রুবাই ১৩
স্রষ্টা যদি মত নিতে মোর – আসতাম না প্রাণান্তেও,
এই ধরাতে এসে আবার যাবার ইচ্ছা নেই মোটেও।
সংক্ষেপে কই, চিরতরে নাশ করতাম সমূলে
যাওয়া-আসা জন্ম আমার, সে-ও শূন্য শূন্য এ-ও!

রুবাই ১৪
আত্মা আমার! খুলতে যদি পারতিস এই অস্থিমাস
মুক্ত পাখায় দেব্তা-সম পালিয়ে যেতিস দূর আকাশ।
লজ্জা কি তোর হল না রে, ছেড়ে তোর ওই জ্যোতির্লোক
ভিনদেশি-প্রায় বাস করতে এলি ধরায় এই আবাস?

রুবাই ১৫
সকল গোপন তত্ত্ব জেনেও পার্থিব এই আবহাওয়ার
মিথ্যা ভয়ের ভয় গেল না? নিত্য ভয়ের হও শিকার?
জানি স্বাধীন ইচ্ছামতো যায় না চলা এই ধরায়,
যতটুকু সময় তবু পাও হাতে, লও সুযোগ তার।

রুবাই ১৬
ব্যথায় শান্তি লাভের তরে থাকত যদি কোথাও স্থান
শ্রান্ত পথের পথিক মোরা সেথায় জুড়াতাম এ প্রাণ।
শীত-জর্জর হাজার বছর পরে নবীন বসন্তে
ফুলের মতো উঠতো ফুটে মোদের জীবন-মুকুল ম্লান।

রুবাই ১৭
বুলবুলি এক হালকা পাখায় উড়ে যেতে গুলিস্তান
দেখল হাসিখুশি-ভরা গোলাপ লিলির ফুল-বাথান।
আনন্দে সে উঠল গাহি, ‘মিটিয়ে নে সাধ এ বেলা,
ভোগ করতে এমন দিন আর পাবিনে তুই ফিরিয়ে প্রাণ!’

রুবাই ১৮
রূপ-মাধুরীর মাথায় তোমার য-দিন পার, লো প্রিয়া,
তোমার প্রেমিক বধূর ব্যথা হরণ করো প্রেম দিয়া।
রূপ-লাবণির সম্ভার এই রইবে না সে চিরকাল,
ফিরবে না আর তোমার কাছে যায় যদি বিদায় নিয়া।

রুবাই ১৯
সাকি! আনো আমার হাতে মদ-পেয়ালা, ধরতে দাও!
প্রিয়ার মতন ও মদ-মদির সুরত-ওয়ালি ধরতে দাও!
জ্ঞানী এবং অজ্ঞানীরে বেঁধে যা দেয় গাঁট-ছড়ায়,
সেই শরাবের শিকল, সাকি, আমায় খালি পরতে দাও।

রুবাই ২০
নীল আকাশের নয়ন ছেপে বাদল-অশ্রুজল ঝরে,
না পেলে আজ এই পানীয় ফুটত না ফুল বন ভরে।
চোখ জুড়াল আমার যেমন আজ এ ফোটা ফুলগুলি,
মোর কবরে ফুটবে যে ফুল – কে জানে হায় কার তরে!

রুবাই ২১
করব এতই শিরাজি পান পাত্র এবং পরান ভোর
তীব্র-মিঠে খোশবো তাহার উঠবে আমার ছাপিয়ে গোর।
থমকে যাবে চলতে পথিক আমার গোরের পাশ দিয়ে,
ঝিমিয়ে শেষে পড়বে নেশায় মাতাল-করা গন্ধে ওর।

রুবাই ২২
দেখতে পাবে যেথায় তুমি গোলাপ লালা ফুলের ভিড়,
জেনো, সেথায় ঝরেছিল কোনো শাহানশা-র রুধির।
নার্গিস আর গুল-বনোসার দেখবে যেথায় সুনীল দল,
ঘুমিয়ে আছে সেথায় – গালে তিল ছিল যে সুন্দরীর।

রুবাই ২৩
নিদ্রা যেতে হবে গোরে অনন্তকাল, মদ পিয়ো।
থাকবে নাকো সাথি সেথায় বন্ধু প্রিয় আত্মীয়।
আবার বলতে আসব না ভাই, বলছি যা তা রাখ শুনে–
ধরেছে যে ফুলের মুকুল, ফুটতে পারে আর কি ও?

রুবাই ২৪
বিদায় নিয়ে আগে যারা গেছে চলে, হে সাকি,
চির-ঘুমে ঘুমায় তারা মাটির তলে, হে সাকি!
শরাব আনো, আসল সত্য আমার কাছে যাও শুনে,
তাদের যত তথ্য গেল হাওয়ায় গলে, হে সাকি!

রুবাই ২৫
তুমি আমি জন্মিনিকো – যখন শুধু বিরামহীন
নিশীথিনীর গলা ধরে ফিরত হেথায় উজল দিন;
বন্ধু ধীরে চরণ ফেলো! কাজল-আঁখি সুন্দরীর
আঁখির তারা আছে হেথায় হয়তো ধূলির অঙ্কলীন!

রুবাই ২৬
প্রথম থেকেই আছে লেখা অদৃষ্টে তোর যা হবার,
তাঁর সে কলম দিয়ে – যিনি দুঃখে সুখে নির্বিকার।
স্রেফ বোকামি, কান্নাকাটি লড়তে যাওয়া তাঁর সাথে,
বিধির লিখন ললাট-লিপি টলবে না যা জন্মে আর!

রুবাই ২৭
ভালো করেই জানি আমি, আছে এক রহস্য-লোক,
যায় না বলা সকলকে তা ভালোই হোক কি মন্দ হোক।
আমার কথা ধোঁয়ায় ভরা, ভাঙতে তবু পারব না –
থাকি সে কোন গোপন-লোকে, দেখতে যাহা পায় না চোখ।

রুবাই ২৮
চলবে নাকো মেকি টাকার কারবার আর, মোল্লাজি!
মোদের আবাস সাফ করে নেয় সেয়ান-ঝাড়ুর কারসাজি।
বেরিয়ে ভাঁটি-খানার থেকে বলল হেঁকে বৃদ্ধ পির –
‘অনন্ত ঘুম ঘুমাবি কাল পান করে নে মদ আজি!’

রুবাই ২৯
সবকে পারি ফাঁকি দিতে মনকে নারি ঠারতে চোখ,
খোদার উপর খোদাকারিতে ব্যর্থ হয় এ মিছে স্তোক।
তীক্ষ্ণ সূক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে জাল বুনিলাম চাতুর্যের,
মুহূর্তে তা দিল ছিঁড়ে হিংস্র নিয়তির সে নোখ!

রুবাই ৩০
মৃত্তিকা-লীন হবার আগে নিয়তির নিঠুর করে
বেঁচে নে তুই, মৃত্যু-পাত্র আসছে রে ওই তোর তরে!
হেথায় কিছু জোগাড় করে নে রে, হোথায় কেউ সে নাই
তাদের তরে – শূন্য হাতে যায় যাহারা সেই ঘরে।

রুবাই ৩১
বলতে পার, অসার-শূন্য ভবের হাটের এই ঘরে
জ্ঞান-বিলাসী সুধীজনের হৃদয় কেন রয় পড়ে?
যেই তাহারা শ্রান্ত হয়ে এই সে ঘরের শান্তি চায়,
‘সময় হল, চল ওরে’, কয় অমনি মরণ হাত ধরে!

রুবাই ৩২
খাজা! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আর্জি এই–
থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই।
দৃষ্টি-দোষে দেখছ বাঁকা আমার সোজা সরল পথ,
আমায় ছেড়ে ভালো করো ঝাপসা তোমার চক্ষুকেই।

রুবাই ৩৩
কাল কী হবে কেউ জানে না, দেখছ তো হায়, বন্ধু মোর!
নগদ মধু লুঠ করে লও, মোছো মোছো অশ্রু-লোর।
চাঁদনি-তরল শরাব পিয়ো, হায়, সুন্দর এই সে চাঁদ
দীপ জ্বালিয়ে খুঁজবে বৃথাই কাল এ শূন্য ধরার ক্রোড়।

রুবাই ৩৪
প্রেমিকরা সব আমার মতো মাতুক প্রেমের মত্ততায়,
দ্রাক্ষা-রসের দীক্ষা নিয়ে আচার-নীতি দলুক পায়।
থাকি যখন সাদা চোখে, সব কথাতে রুষ্ট হই,
শরাব পিয়ে দিল-দরিয়া উড়িয়ে দি ভয়-ভাবনায়।

রুবাই ৩৫
মানব দেহ – রঙে-রূপে এই অপরূপ ঘরখানি–
স্বর্গের সে শিল্পী কেন করল সৃজন কী জানি,
এই ‘লাল-রুখ’ বল্লি-তনু ফুল-কপোল তন্বীদের
সাজাতে হায় ভঙ্গুর এই মাটির ধরার ফুলদানি!

রুবাই ৩৬
তিন ভাগ জল এক ভাগ থল এই পৃথিবীর এও মায়া,
এই ধরাতে দেখছ যা তার সকল-কিছু সব মায়া,
এই যে তুমি বলছ যা সব, শুনছ কলরব – মায়া।
গোপন প্রকাশ সত্য মিথ্যা এ সব অবাস্তব মায়া।

রুবাই ৩৭
দোষ দেয় আর ভর্ৎসে সবাই আমার পাপের নাম নিয়া,
আমার দেবী-প্রতিমারে পূজি তবু প্রাণ দিয়া।
মরতে যদি হয় গো আমায় শরাব-পানের মজলিশে–
স্বর্গ-নরক সমান, পাশে থাকবে শরাব আর প্রিয়া।

রুবাই ৩৮
মুসাফিরের এক রাত্রির পান্থ-বাস এ পৃথ্বীতল–
রাত্রি-দিবার চিত্র-লেখা চন্দ্রাতপ আঁধার-উজল।
বসল হাজার জামশেদ ওই উৎসবেরই আঙিনায়
লাখ বাহ্রাম এই আসনে বসে হল বেদখল।

রুবাই ৩৯
কারুর প্রাণে দুখ দিয়ো না, করো বরং হাজার পাপ,
পরের মনে শান্তি নাশি বাড়িয়ো না তার মনস্তাপ।
অমর-আশিস লাভের আশা রয় যদি, হে বন্ধু মোর,
আপনি সয়ে ব্যথা, মুছো পরের বুকের ব্যথার ছাপ।

রুবাই ৪০
ছেড়ে দে তুই নীরস বাজে দর্শন আর শাস্ত্রপাঠ,
তার চেয়ে তুই দর্শন কর প্রিয়ার বিনোদ বেণির ঠাট;
ওই সোরাহির হৃদয়-রুধির নিষ্কাশিয়া পাত্রে ঢাল,
কে জানে তোর রুধির পিয়ে কখন মৃত্যু হয় লোপাট।

রুবাই ৪১
অজ্ঞানেরই তিমির-তলের মানুষ ওরে বে খবর!
শূন্য তোরা, বুনিয়াদ তোর গাঁথা শূন্য হাওয়ার পর।
ঘুরিস অতল অগাধ খাদে, শূন্য মায়ার শূন্যতায়,
পশ্চাতে তোর অতল শূন্য, অগ্রে শূন্য অসীম চর।

রুবাই ৪২
লয়ে শরাব-পাত্র হাতে পিই যবে তা মস্ত হয়ে
জ্ঞানহারা হই সেই পুলকের তীব্র-ঘোর বেদন সয়ে,
কী যেন এক মন্ত্রবলে যায় ঘটে কী অলৌকিক,
প্রোজ্জ্বল মোর জ্ঞান গলে, যায় ঝরনাসম গান বয়ে।

রুবাই ৪৩
‘শরাব ভীষণ খারাপ জিনিস মদ্যপায়ীর নেইকো ত্রাণ।’
ডাইনে বাঁয়ে দোষদর্শী সমালোচক ভয় দেখান –
সত্য কথাই! যে আঙুরে নষ্ট করে ধর্মমত,
সবার উচিত – নিঙড়ে ওরে করে উহার রক্ত পান!

রুবাই ৪৪
আমার কাছে শোন উপদেশ – কাউকে কভু বলিসনে–
মিথ্যা ধরায় কাউকে প্রাণের বন্ধু মেনে চলিসনে!
দুঃখ ব্যথায় টলিসনে তুই, খুঁজিসনে তার প্রতিষেধ,
চাসনে ব্যথার সমব্যথী, শির উঁচু রাখ ঢলিসনে!

রুবাই ৪৫
মউজ চলুক! লেখার যা তা লিখল ভাগ্য কালকে তোর,
ভুলেও কেহ পুঁছল নাকি থাকতে পারে তোর ওজর !
ভদ্রতারও অনুমতি কেউ নিল না অমনি ব্যস
ঠিক ঠাক সব হয়ে গেল ভুগবি কেমন জীবন-ভোর!

রুবাই ৪৬
আমি চাহি স্রষ্টা আবার সৃজন করুন শ্রেষ্ঠতর
আমি চাহি স্রষ্টা আবার সৃজন করুন শ্রেষ্ঠতর
সেই সাথে চাই – সৃষ্টি-খাতায় দিক কেটে সে আমার নাম,
কিংবা আমার যা প্রয়োজন তা মিটাবার দিক সে বর।

রুবাই ৪৭
নাস্তিক আর কাফের বলো তোমরা লয়ে আমার নাম,
কুৎসা গ্লানির পঙ্কিল স্রোত বহাও হেথা অবিশ্রাম।
অস্বীকার তা করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই,
কুৎসিত এই গালি দিয়েই তোমরা যাবে স্বর্গধাম?

রুবাই ৪৮
বদখশানী রক্ত-চুনির মতন সুরা চুঁইয়ে আন
তপ্তহিয়ার আনন্দ যা, শান্ত যাহে দগ্ধ প্রাণ।
মুসলমানের তরে শরাব হারাম নাকি, সবাই কয়,
বলতে পারে তাদের কেহ – আছে কি আর মুসলমান?

রুবাই ৪৯
মসজিদ মন্দির গির্জায় ইহুদ-খানায় মাদ্রাসায়
রাত্রি-দিবস নরক-ভীতি স্বর্গ সুখের লোভ দেখায়।
ভেদ জানে আর খোঁজ রাখে ভাই খোদার যারা রহস্যের
ভোলে না এই খোশ-গল্পের ঘুম-পাড়ানো কল্পনায়।

রুবাই ৫০
এক হাতে মোর তসবি খোদার, আর-হাতে মোর লাল গেলাস,
অর্ধেক মোর পুণ্য-স্নাত, আধেক পাপে করল গ্রাস।
পুরোপুরি কাফের নহি, নহি খাঁটি মুসলমানও–
করুণ চোখে হেরে আমায় তাই ফিরোজা নীল আকাশ।

রুবাই ৫১
একমনি ওই মদের জালা গিলব, যদি পাই তাকে,
যে জালাতে প্রাণের জ্বালা নেভাবার ওষুধ থাকে!
পুরানো ওই যুক্তি তর্কে দিয়ে আমি তিন তালাক,
নতুন করে করব নিকাহ্ আঙুর-লতার কন্যাকে।

রুবাই ৫২
বিষাদের ওই সওদা নিয়ে বেড়িয়ো না ভাই শিরোপরি,
আঙুর-কন্যা সুরার সাথে প্রেম করে যাও প্রাণ ভরি!
নিষিদ্ধা ওই কন্যা, তবু হোক সে যতই অ-সতী,
তাহার সতী মায়ের চেয়ে ঢের বেশি সে সুন্দরী!

রুবাই ৫৩
স্বর্গে পাব শরাব-সুধা, এ যে কড়ার খোদ খোদার,
ধরায় তাহা পান করলে পাপ হয়, এ কোন বিচার?
‘হামজা’ সাথে বেয়াদবি করল মাতাল এক আরব–
তুচ্ছ কারণ – শরাব হারাম তাই হুকুমে ‘মোস্তফার’।

রুবাই ৫৪
‘রজব শাবান পবিত্র মাস’ বলে গোঁড়া মুসলমান,
‘সাবধান, এই দু-মাস ভাই কেউ করো না শারাব পান।’
খোদা এবং তার রসুলের ‘রজব’ ‘শাবান’ এই দু-মাস
পান-পিয়াসীর তরে তবে সৃষ্ট বুঝি এ ‘রমজান’?

রুবাই ৫৫
শুক্রবার আজ, বলে সবাই পবিত্র নাম জুম্মা যার,
হাত যেন ভাই খালি না যায়, শরাব চলুক আজ দেদার।
এক পেয়ালি শরাব যদি পান করো ভাই অন্যদিন,
দু-পেয়ালি পান করো আজ বারের বাদশা জুম্মা বার!

রুবাই ৫৬
মসজিদের অযোগ্য আমি, গির্জার আমি শত্রু-প্রায়,
ওগো প্রভু, কোন মাটিতে করলে সৃজন এই আমায়?
সংশয়াত্মা সাধু কিংবা ঘৃণ্য নগর-নারীর তুল
নাই স্বর্গের আশা আমার, শান্তি নাহি এই ধরায়।

রুবাই ৫৭
মুগ্ধ করো নিখিল-হৃদয় প্রেম-নিবেদন কৌশলে
হৃদয়জয়ী হে বীর, উড়াও নিশান প্রিয়ার অঞ্চলে।
এক হৃদয়ের সমান নহে লক্ষ ম-জিদ আর ‘কাবা’;
কী হবে তোর তীর্থে ‘কাবা’র শান্তি খোঁজ হৃদয় তলে।

রুবাই ৫৮
বিধর্মীদের ধর্মপথে আসতে লাগে এক নিমেষ,
সন্দেহেরই বিপথ-ফেরত বিবেক জাগে এক নিমেষ।
দুর্লভ এই নিমেষটুকু ভোগ করে নাও প্রাণ ভরে,
এই ক্ষণিকের আয়েস দিয়ে জীবন ভাসে এক নিমেষ।

রুবাই ৫৯
হৃদয় যাদের অমর প্রেমের জ্যোতির্ধারায় দীপ্তিমান,
মসজিদ মন্দির গির্জা, যথাই করুক অর্ঘ্য দান–
প্রেমের খাতায় থাকে লেখা অমর হয়ে তাদের নাম,
স্বর্গের লোভ ও নরক-ভীতির ঊর্ধ্বে তারা মুক্ত-প্রাণ।

রুবাই ৬০
মদ পিয়ো আর ফুর্তি করো – আমার সত্য আইন এই!
পাপ পুণ্যের খোঁজ রাখি না – স্বতন্ত্র মোর ধর্ম সেই।
ভাগ্য সাথে বিয়ের দিনে কইনু, ‘দিবি কি যৌতুক?’
কইল বধূ, ‘খুশি থাকো, তার বড়ো যৌতুক সে নেই!’

রুবাই ৬১
এক সোরাহি সুরা দিয়ো, একটু রুটির ছিলকে আর
প্রিয়া সাকি, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ,
এই যদি পাই চাইব নাকো তখ্ত আমি শাহানশার!

রুবাই ৬২
হুরি বলে থাকলে কিছু – একটি হুরি, মদ খানিক,
ঘাস-বিছানো ঝরনাতীরে, অল্প-বয়েস বৈতালিক–
এই যদি পাস, স্বর্গ নামক পুরনো সেই নরকটায়
চাসনে যেতে, স্বর্গ ইহাই স্বর্গ যদি থাকেই ঠিক।

রুবাই ৬৩
যতক্ষণ এ হাতের কাছে আছে অঢেল লাল শরাব
গেহুঁর রুটি, গরম কোরমা, কালিয়া আর শিক-কাবাব,
আর লাল-রুখ প্রিয়া আমার কুটির-শয়ন-সঙ্গিনী, –
কোথায় লাগে শাহানশাহের দৌলত ওই বে-হিসাব!

রুবাই ৬৪
দোষ দিয়ো না মদ্যপায়ীর তোমরা, যারা খাও না মদ;
ভালো করার থাকলে কিছু, মদ খাওয়া মোর হত রদ।
মদ না পিয়েও, হে নীতিবিদ, তোমরা যেসব কর পাপ,
তাহার কাছে আমরাও শিশু, হই না যতই মাতাল-বদ!

রুবাই ৬৫
খুশি-মাখা পেয়ালাতে ওই গোলাপ-রক্ত মদ-মধুর!
মধুরতর পাখির গীতি, বেণুর ধ্বনি, বীণার সুর।
কিন্তু ওই যে ধর্মগোঁড়া – বুঝল না যে মদের স্বাদ,
মধুরতম – রয় সে যখন অন্তত পাঁচ যোজন দূর!

রুবাই ৬৬
চৈতি-রাতে খুঁজে নিলাম তৃণাস্তৃত ঝরনা-তীর,
সুন্দরী এক হুরি নিলাম, পেয়ালা নিলাম লাল পানির।
আমার নামে বইল হাজার কুৎসা গ্লানির ঝড় তুফান,
ভুলেও মনে হল না মোর স্বর্গ নরকের নজির।

রুবাই ৬৭
সাকি-হীন ও শরাব-হীনের জীবনে হায় সুখ কী বলো?
নাই ইরাকি-বেণুর ধ্বনির জমজমাটি সুর-উছল
সুখ নাই ভাই সেথায় থেকে, এই জগতের তত্ত্ব শোনো,
আনন্দহীন জীবন-বাগে ফলে শুধু তিক্ত ফল।

রুবাই ৬৮
মরুর বুকে বসাও মেলা, উপনিবেশ আনন্দের,
একটি হৃদয় খুশি করা তাহার চেয়ে মহৎ ঢের।
প্রেমের শিকল পরিয়ে যদি বাঁধতে পার একটি প্রাণ–
হাজার বন্দি মুক্ত করার চেয়েও অধিক পুণ্য এর।

রুবাই ৬৯
শরাব এবং প্রিয়ায় নিয়ে, সাকি, হেথায় এলাম ফের!
তৌবা করেও পাইনে রেহাই হাত হতে ভাই এই পাপের।
‘নূহ’ আর তাঁর প্লাবন-কথা শুনিয়ো নাকো আর, সাকি,
তার চেয়ে মদ-প্লাবন এনে ডুবাও ব্যথা মোর বুকের!

রুবাই ৭০
নৃত্য-পাগল ঝরনাতীরে সবুজ ঘাসের ওই ঝালর
উন্মুখ কার চুমো যেন দেবকুমারের ঠোঁটের পর –
হেলায় পায়ে দলো না কেউ – এই যে সবুজ তৃণের ভিড়
হয়তো কোনো গুল-বদনীর কবর-ঢাকা নীল চাদর।

রুবাই ৭১
আমার ক্ষণিক জীবন হেথায় যায় চলে ওই ত্রস্ত পায়
খরস্রোতা স্রোতস্বতী কিংবা মরুঝঞ্ঝা-প্রায়।
তারই মাঝে এই দু-দিনের খোঁজ রাখি না – ভাবনা নাই,
যে গতকাল গত, আর যে আগামীকাল আসতে চায়।

রুবাই ৭২
আর কতদিন সাগরবেলায় খামকা বসে তুলব ইঁট!
গড় করি পায়, দিক লেগেছে গড়ে গড়ে মূর্তি পীঠ।
ভেবো নাকো – খৈয়াম ওই জাহান্নমের বাসিন্দা,
ভিতরে সে স্বর্গ-চারী, বাহিরে সে নরক-কীট।

**** অন্য রুবাই গুলো ক্রমশ যোগ করা হবে।
শব্দার্থ :
আনন্দ-গুল = ফুল
শিরীন: মিষ্টি, মধুর
ফজুল : অতিরিক্ত
গুলিস্তান = ফুলের বাগান
সুরত = সৌন্দর্য
শিরাজি = ইরানের শিরাজ নগরে উৎপন্ন উৎকৃষ্ট মদ বিশেষ।
খোশবো = সুগন্ধ
গুল-বনোসার = ফুল বিশেষ।
মোল্লাজি = শাস্ত্র পণ্ডিত যে ব্যক্তি মদ্যপানাদি বারণ করেন।
খাজা = পির, গুরুজন, সম্মানিত ব্যক্তি।
আর্জি = নিবেদন
মস্ত : নেশায় সংজ্ঞাহীন
ওজর : অজুহাত, আপত্তি
বদখশানী : চুনির জন্য বিখ্যাত প্রদেশ
কাবা = মক্কার পবিত্র কাবাগৃহ
তখ্ত = সিংহাসন
আরও পড়ুন: