কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর সমসাময়িকেরা ‘যুগের কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন—এটি নিছক প্রশংসাবাক্য নয়, বরং এক নিখুঁত মূল্যায়ন। কিন্তু কাকে ‘যুগের কবি’ বলা চলে? যিনি কালের দাবি মেটান, যিনি সময়ের সংকটে মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন—তিনিই তো প্রকৃত অর্থে যুগের কবি। নজরুল তেমনই এক কবি, যিনি শুধু তাঁর সময়ের প্রয়োজন মিটিয়েই থেমে থাকেননি; তিনি রেখে গেছেন এমনসব চিন্তা ও উচ্চারণ, যা আজও প্রাসঙ্গিক, কালেও থাকবে। তাই তিনি কেবল যুগের নন—তিনি কালের কবি, এবং সেই সঙ্গে কালোত্তীর্ণ।
নজরুলের আবির্ভাব যেন ধূমকেতুর মতো—চমকপ্রদ, তীব্র এবং দৃপ্ত। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তিনি তুলেছিলেন দ্রোহের পতাকা। অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর ভাষা ছিল অগ্নিগর্ভ, তাঁর ঘোষণা ছিল স্পষ্ট—‘অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ’ স্তব্ধ না হওয়া পর্যন্ত তিনি থামবেন না। তবে নজরুল শুধু বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেই থেমে যাননি; তিনি বুঝেছিলেন, উপনিবেশবাদী শক্তি বিদায় নিলেও শান্তি আসবে না, যদি না সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ সম্পূর্ণভাবে দূর করা যায়। এই শত্রুর শিকড় সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত—একে উপড়ে না ফেললে মানুষের প্রকৃত মুক্তি অসম্ভব। নজরুলের এই বোধ, এই দূরদৃষ্টি আজ শত বছর পরও সত্য বলে প্রতিভাত হয়। এক কালে যে সাম্প্রদায়িকতার রূপ ছিল হিংসাত্মক সহিংসতা, আজ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও ভয়াবহ উপাদান—জঙ্গিবাদ।
নজরুলের সংগ্রামের আরেকটি দিক ছিল নারীমুক্তি। সমাজের অর্ধেক মানুষকে গৃহবন্দি রেখে, ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির শৃঙ্খলে বেঁধে রেখে কোনও জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়—এই বিশ্বাসে তিনি ছিলেন অটল। নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন তীব্র কণ্ঠস্বর। নজরুলের যুগে নারীমুক্তির প্রশ্নে তাঁর মতো কঠোর ও নির্ভীক অবস্থান আর কেউ গ্রহণ করেননি।
সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে নজরুল যেভাবে কলম ধরেছিলেন, আজ উপমহাদেশে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে তাঁর মতো স্পষ্টভাষী হওয়াও যেন কঠিন হয়ে উঠেছে। আজ ধর্মীয় উগ্রতা বহুগুণে বেড়েছে, আর যারা এই ঘৃণা ছড়িয়ে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে—তারা যে ধর্মেরই অনুসারী হোক, নজরুল তাঁদের দেখেছেন পশু হিসেবে—সাধারণ নিরীহ পশু নয়, বরং হিংস্র দাঁত-নখ-শিংওয়ালা পশু, যারা রক্ত ঝরাতে জানে। তিনি তাঁদের আঘাত করেছেন সরাসরি ভাষায়, এমন ভাষায় যা তারা বুঝতে বাধ্য।
বিশ শতকের দুই দশকে, যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে, তখনও নজরুলের মূল উদ্বেগ ছিল ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতা। তাঁর বিশ্বাস ছিল—ভারতবর্ষ নিশ্চয়ই স্বাধীন হবে, কিন্তু যদি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজন থেকে যায়, তবে স্বাধীনতার স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে না। তাই তাঁর সাহিত্য ও কর্মে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধিতাও হয়ে ওঠে সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে তিনি এমনকি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও গভীর আলোচনা করেছেন, সেই সময়ের উত্তাল বাস্তবতায় দুই কবির মনযোগের কেন্দ্রে ছিল মানবতা ও সাম্যের প্রশ্ন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু বিস্তারিত জানা না গেলেও তার সারমর্ম জানিয়েছেন নজরুল তাঁর এক লেখায়। তাঁর ভাষায়:
“একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন: দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?
হিন্দু-মুসলমানের কথা মনে উঠলে আমার বারে বারে গুরুদেবের ঐ কথাটাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে যে, এ ন্যাজ গজালো কি করে? এর আদি উদ্ভব কোথায়? ঐ সঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদেরই গজায়—তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক—তারাই হয়ে ওঠে পশু। যে সব ন্যাজওয়ালা পশুর হিংস্রতা সরল হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে—শৃঙ্গরূপে, তাদের ততো ভয়ের কারণ নেই, যত ভয় হয় সেই সব পশুদের দেখে—যাদের হিংস্রতা ভিতরে, যাদের শিং মাথা ফুটে বেরোয়নি। শিংওয়ালা গরু-মহিষের চেয়ে শৃঙ্গবিহীন ব্যাঘ্র-ভল্লুক জাতীয় পশুগুলো বেশি হিংস্র—বেশি ভীষণ এ হিসেবে মানুষও পড়ে ঐ শৃঙ্গহীন বাঘ–ভালুকের দলে। কিন্তু বাঘ-ভালুকের তবু ন্যাজটা বাইরে, তাই হয়ত রক্ষে। কেননা, ন্যাজ আর শিং দুইই ভিতরে থাকলে কী রকম হিংস্র হয়ে উঠতে হয়, তা হিন্দু-মুসলমানের ছোরা-মারা না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। [ ‘হিন্দু-মুসলমান’]”
বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে যখন হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার রূপ নেয়, তখন কাজী নজরুল ইসলাম নিজের কবিতা ও গদ্যে সেই বিভেদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন :
“হিন্দু মুসলমানী কাণ্ড’ বেধে যাওয়ার পর দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পরস্পরের মার খেয়ে ‘হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে, “বাবাগো, মাগো”—মাতৃপরিত্যক্ত দুটি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে।’ [মন্দির ও মসজিদ] তিনি লিখেছেন, ‘দেখিলাম, হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদী চির-কলঙ্কিত হইয়া রহিল।”
নজরুল সাম্প্রদায়িক হানাহানিকারীদের ‘ধর্ম-মাতাল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল,
‘ধর্ম-মাতাল’। ‘ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের এলকোহল পান করিয়াছে।’
যেমন অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন একজন মাতালকে অনিবার্য ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়, তেমনই ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি করা ‘ধর্ম-মাতাল’-দেরও করুণ পরিণতির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।
তিনি আরও বলেন,
‘অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি—আলোর মত, সকলের জন্য।’
ধর্মের ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে বিবাদের প্রসঙ্গে নজরুলের ভাষায়,
‘আলো নিয়ে কখনও ঝগড়া করে না মানুষে, কিন্তু গরু-ছাগল নিয়ে করে।’
নজরুল শুধু সমালোচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, পরিবর্তনের আহ্বানও জানিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকার পরিবর্তন আনতে পারেন নেতারা। তাই তিনি তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন, তাঁরা আসল কান্ডারি।
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?
ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ,
সন্তান মোর মা’র!”
নজরুল ছিলেন মুসলিম সমাজের অন্যতম নিবেদিতপ্রাণ শুভার্থী, তবে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল নেতারা তাঁর গঠনমূলক সমালোচনাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। আত্মসংশোধনের আহ্বানকে উপেক্ষা করে, তাঁরা বরং নজরুলকেই আক্রমণ করেছেন। এই বিষয়ে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর সদস্য আনোয়ার হোসেনকে নজরুল একবার লিখেছিলেন:
“মুসলমান সমাজ আমাকে আঘাতের পর আঘাত দিয়েছে নির্মমভাবে। তবুও আমি দুঃখ করিনি বা নিরাশ হইনি। তার কারণ বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া এবং শিক্ষিত মুসলমানরা ঈর্ষাপরায়ণ।”
নজরুলের বিদ্রোহ ছিল কেবল বিদেশি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক অন্যায়, অবিচার এবং অনাচারের বিরুদ্ধেও। তাঁর নিজস্ব ভাষায়,
‘পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল-কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’
‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
নজরুল আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরাজমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হতে পারেন। সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে তাঁর রচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচি পালন করছে, যা তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তরুণরা যত বেশি নজরুলের লেখনী চর্চা করবে, তত দ্রুত অন্ধকার দূর হয়ে সমাজে আলোর সূচনা হবে। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নজরুলচর্চা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।