মোহর্রম প্রবন্ধ [ রুদ্র-মঙ্গল ] কাজী নজরুল ইসলাম

মোহর্রম প্রবন্ধ [ রুদ্র-মঙ্গল ] কাজী নজরুল ইসলাম :

ফিরে এসেছে আজ সেই মোহর্রম – সেই নিখিল-মুসলিমের ক্রন্দন-উৎসবের দিন। কিন্তু সত্য করে আজ কে কেঁদেছে বলতে পার হে মুসলিম? আজ তোমার চোখে অশ্রু নাই। আজ ক্রন্দন-স্মৃতি তোমার উৎসবে পরিণত! তোমার অশ্রু আজ ভণ্ডামি, ক্রন্দন আজ কৃত্রিম কর্কশ চিৎকার।

 

মোহর্রম প্রবন্ধ [ রুদ্র-মঙ্গল ] কাজী নজরুল ইসলাম
Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]

চুপ রও কাপুরুষ। ‘হায় হাসান, হায় হোসেন!’ বলে মিথ্যা বীভৎস চিৎকার করে আর মা ফাতেমার পুত্র-শোকাতুর আত্মাকে পীড়িত করে তুলো না।

এ ক্রন্দন-অভিনয় দেখিয়ে আল্লার মুখ আর কালো করে দিয়ো না। তোমাদের ওই যে উদ্দাম বুক-চাপড়ানির বীভৎসতা, সে ব্যর্থ হয়নি ভীরুর দল! সে আঘাত আল্লার হাবিব হজরত মোহাম্মদের (দঃ) বুকে গিয়ে বেজেছে। যাঁরা ধর্মের জন্যে সত্যের জন্যে জান কোরবান করেছেন, আজ সেই শহিদ বীরদের জন্যে ক্রন্দন অভিনয় করে আর তাঁদের আত্মার অপমান কোরো না নৃশংস অভিনেতার দল!

তোমার ধর্ম নাই, অস্তিত্ব নাই, তোমার হাতে শম্‌শের নাই, শির নাঙ্গা, তোমার কোরান পর-পদদলিত, তোমার গর্দানে গোলামির জিঞ্জির, যে শির আল্লার আরশ ছাড়া আর কোথাও নত হয় না, সেই শিরকে জোর করে সেজ্‌দা করাচ্ছে অত্যাচারী শক্তি – আর তুমি করছ আজ সেই শহিদদের – ধর্মের জন্য স্বাধীনতার জন্য শহিদদের – ‘মাতমে’র অভিনয়! আপশোশ আপশোশ – মুসলিম! আপশোশ!!

 

Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]
Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]

কোথায় কারবালা-মাতম তা কি দেখেছ, অন্ধ? একবার চোখ খুলে দেখো, দেখবে কোথায় কারবালার দুপুরে মাতম হাহাকার-রবে ক্রন্দন করে ফিরছে। আজ কারবালা শুধু আরবের ওই ধু-ধু সাহারার বুকে নয়, ওই ফোরাত নদীর কূলে নয় – আজ কারবালার হাহাকার ওই নিখিল নিপীড়িত মুসলিমের বুকের সাহারায়, তোমার অপমান-জর্জরিত অশ্রু-নদীর কূলে!

মা ফাতেমা আরশের পায়া ধরে কাঁদছেন, স্কন্ধে তাঁর হাসানের বিষ-মাখা নীল পিরান আর হোসেনের খুন-মাখা রক্ত-উত্তরীয়। পুত্র-হারার আকুল ক্রন্দন খোদার আরশ কেঁপে উঠছে।

[ মোহর্রম প্রবন্ধ [ রুদ্র-মঙ্গল ] কাজী নজরুল ইসলাম  ]

হে যুগে যুগে শোক-অভিনেতা মুসলিমের দল! থামাও – থামাও মা ফাতেমার ক্রন্দন – থামাও আল্লার আরশের ভীতি-কম্পন। তোমার স্বাধীনতাকে তোমার সত্যকে তোমার ধর্মকে যে-এজিদের বংশধরেরা লাঞ্ছিত নিপীড়িত করছে, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের ভূ-অবলুণ্ঠিত শির উঁচু হয়ে উঠুক। তোমার ইসলামকে অক্ষতদেহ উন্নতশির করে রাখো, তোমার স্বাধীনতা তোমার সত্যকে রক্ষা করো, দেখবে পুত্রশোকাতুরা জননী মা ফাতেমার ক্রন্দন থেমে গিয়েছে, আল্লার আরশের কম্পন থেমেছে।

 

Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]
Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]

ওই শোনো কাসেমের অতৃপ্ত আত্মা ফরিয়াদ করে ফিরছে – তৃষ্ণা, তৃষ্ণা!’ কে দেবে এ-তৃষ্ণাতুর তরুণকে তৃষ্ণার জল? এ-তৃষ্ণা আবে-জমজম আবে-কওসরেও মিটবার নয়। এ-কারবালার মরু-দগ্ধ পিয়াসি চায় নিখিল-মুসলিম তরুণের রক্ত, ধর্ম আর স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে প্রাণ-বলিদান। কে আছ অরুণ-খুনের তরুণ-শহিদ মুসলিম, কাসেমের এ-তৃষ্ণা এ-ক্রন্দন-তিক্ততা মেটাবে?

ওই শোনো সদ্য স্বামীহারা বালিকা সকীনার মর্মভেদী ক্রন্দন, সে চায় না তার স্বামী কাসেমের প্রাণ, সে চায় ইসলামের স্বাধীনতা-রক্ষার জন্যে কাসেমের মতো প্রাণ-বলিদান।

আজ নিখিল মুসলিম-অঙ্গন তোমার কারবালা-প্রান্তরে হে মুসলিম! তার মাঝে আকুল অবিশ্রাম-ক্রন্দন গুমরে ফিরেছে – ‘তৃষ্ণা – তৃষ্ণা!’

আল্লার পানে তাকাও, রসুলের দিকে চেয়ে দেখো, মা ফাতেমা, হজরত আলির মাতম শোনো, কাসেমের, সকীনার – অতৃপ্তির আকুল কাঁদন-রনরনি শোনো, কচি শিশু আসগরের তির-বেঁধা কাঁচা কলিজার খুন-খারাবির কথা স্মরণ করো, আর তোমার কর্তব্য নির্ধারণ করো, হে মুসলিম! মোহর্রমের খুন-খারাবি আজ তোমার লক্ষ্য স্থির করে দিক। আজিন!

 

মোহর্রম প্রবন্ধ [ রুদ্র-মঙ্গল ] কাজী নজরুল ইসলাম

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment