ব্যথার দান : বেদৌরার কথা : বোস্তান : আঃ মাগো কী ব্যথিত পাণ্ডুর আকাশ! এই যে এত বৃষ্টি হয়ে গেল, ও অসীম আকাশের কান্না নয় তো? – না, না, এত উদার যে, সে কাঁদবে কেন? আর কাঁদলেও তার অশ্রু আমাদের সংকীর্ণ পাপ-পঙ্কিল চোখের জলের মতো বিস্বাদ আর উষ্ণ নয় তো! দেখছ, সে কত ঠান্ডা! …
[ ব্যথার দান : বেদৌরার কথা : বোস্তান ]
তিনি যে ফিরে আসবেনই, সে তো জানা কথা। কিন্তু এত দিনে কেন? এ অসময়ে কেন নাথ? এখন যে আমার মালতীর লতা রিক্তকুসুম! ওগো, এ মরণের তটে এ দুর্দিনে কী দিয়ে বাসর সাজাব? যদি এলেই তবে কেন দুদিন আগেই এলে না? তা হলে তো তোমায় এমন করে এড়িয়ে চলতে হত না সেই দিনই – যেদিন আবার ওই চমনের শুকনো বাগানের ধারে তোমায় দেখতে পেয়েছিলাম – সেই দিনই তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতাম, – ‘এসো প্রিয়, ফিরে এসো!’ ওগো! হতভাগিনি – আমি যে হৃদয়ের সে পবিত্রতা রক্ষা করতে পারিনি! ওই শোনো দূরে আমার সমবেদনায় কী একটা জানোয়ার কাতরে উঠেছে – উঃ উঃ উঃ।
আমরা নারী, একটুতেই যত কেঁদে ভাসিয়ে দিতে পারি, পুরুষরা তা তো পারে না। তাদের বুকে যেন সব সময়েই কীসের পাথর চাপা। তাই যখন অনেক বেদনায় এই সংযমী পুরুষদের দুটি ফোঁটা অসংবরণীয় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, তখন তা দেখে না কেঁদে থাকতে পারে, এমন নারী তো আমি দেখি না! –
সেদিন যখন কত বছর পরে আমাদের চোখাচোখি হল, তখন কত মিনতি-অনুযোগ আর অভিমান মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল আমাদের চারটি চোখেরই সজল চাউনিতে! – হাঁ, আর কেমন ‘বেদৌরা’ বলে মাথা ঘুরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে ওই খেজুরের কাঁটা-ঝোপটায় পড়ে গেল! আঃ আঃ, তা দেখে পাষাণী-আমি কী করেই সে চোখ দুটো জোর করে দুই হাত দিয়ে চেপে এত দূর যেন কোনো অন্ধ অমানুষিক শক্তির বলে ছুটে এলাম?
পুরোনো কত স্মৃতিই আজ আমার বুকে ছেপে উঠছে! সেই গোলেস্তানে এক জোড়া বুলবুলেরই মতো মিলনেই অভিমান, মিলনেই বিচ্ছেদ-ব্যথা আর তারই প্রগাঢ় আনন্দে অজস্র অশ্রুপাত! তার চিন্তাটাও কত ব্যথিত-বিধুর! – তারপর সেই জুয়াচোরের জোর করে আমায় ছিনিয়ে নেওয়া দয়িতের বুক থেকে, – অনেক কষ্টে তার হাত এড়িয়ে প্রিয়ের অন্বেষণ! – ওঃ কি-ই না করেছি তাকে আবার পেতে! কই তখনও তো তিনি এলেন না!
এই বাসনার ভোগে যে সুখ, সে হচ্ছে পৈশাচিক সুখ। এতে শুধু দীপক রাগিণীর মতো পুড়িয়েই দিয়ে যায় আমাদের! অথচ এই দীপকের আগুন একবার জ্বলে উঠবেই আমাদের জীবনের নব-ফাল্গুনে। সেই সময় স্নিগ্ধ মেঘ-মল্লারের মতো সান্ত্বনার একটা-কিছু পাশে না থাকলে সে যে জ্বলবেই – দীপক যে তাকে জ্বালাবেই!
তাই তো যেদিন পুষ্পিত যৌবনের ভারে আমি ঢলে পড়ছিলাম, আর একজন এসে আমায় যাচ্ঞা করলে, তখন আমার এই বাহিরের প্রবৃত্তিটা দমন করবার ক্ষমতাই যে রইল না! তখন যে আমি অন্ধ। – ওগো দেবতা, সেদিন তুমি কোথায় ছিলে? কেউ যে এল না শাসন করতে তখন! হায়, সেই দিনই আমার মৃত্যু হল। সেই দিনই আমি ভিখারিনি হয়ে পথে বসলাম। ওগো, আমার সেই অধঃপতনের দিনে চোখে যে পুঞ্জীভূত অন্ধকারের নিবিড় কালিমা একেবারে ঘন-জমাট হয়ে বসেছিল, তখন, এখনকার মতো এতটুকুও আলোক যে সে-অন্ধকারটাকে তাড়াতে চেষ্টা করেনি। হয়তো একটি রশ্মিরেখার ঈষৎপাতে সব অন্ধকার সেদিন ছুটে পালাত। তা হলে দেখতে গো, কে আমার সমস্ত হৃদয়-আসন জুড়ে রাজাধিরাজ একচ্ছত্র সম্রাটের মতো বসে আছে।
তবু যে আমার এ অধঃপতন হল? তা সেদিনও বুঝতে পারিনি, আজও বুঝতে পারছিনে, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! – কিন্তু আমি যদি বলি, আমার প্রেম – বক্ষের গভীর গোপন-তলে-নিহিত মহান প্রেম, যা সর্বদাই পবিত্র, তা তেমনই পূত অনবদ্য আছে আর চিরকালই থাকবে, তার গায়ে আঁচড় কাটে বাইরের কোনো অত্যাচার-অনাচারের এমন ক্ষমতা নেই, – তা হলে কে বুঝবে? কেই বা আমায় ক্ষমা করবে? – তবু আমি বলব, প্রেম চিরকালই পবিত্র, দুর্জয়, অমর; পাপ চিরকালই কলুষ, দুর্বল আর ক্ষণস্থায়ী।
আবার আমার মনে পড়ছে সেই আমার বিপথে-টেনে-নেওয়া শয়তান সয়ফুল-মুলকের কথা। সে-ই তো যত ‘নষ্টগুড়ের খাজা’। এখন তাকে পেলে নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতাম!
আমারা নারী – মনে করি, এতটুকুতেই আমাদের হৃদয় অপবিত্র হয়ে গেল, আর অনুশোচনায় মনে মনে পুড়ে মরি। আমরা আরও ভাবি যে, হয়তো পুরুষদের অত সামান্যতে পাপ স্পর্শে না। আর তাদের মনে এত তীব্র অনুশোচনাও জাগে না। কিন্তু সেই যে সেদিন, যেদিন আমার বাসনার পিয়াস শুকিয়ে গিয়েছে, আর মধু ভেবে আকণ্ঠ হলাহল পানের তীব্র জ্বালায় ছটফট করচি, আর ঠিক সেই সময় সহসা বিরাট বিপুল হয়ে আমার ভিতরের প্রেমের পবিত্রতা অপ্রতিহত তেজে জেগে উঠেছে – সে-তেজ চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্চে, – সেদিন – ঠিক সেইদিন – সয়ফুল-মুলক সহসা কীরকম ছোটো হয়ে গেল!
কিন্তু এ কী? আবার আমার মনটা কেন আমাকে যেন ভাঙানি দিচ্ছে শুধু একবার দেখে আসতে যে, তিনি তেমনি করে সেই খেজুর-কাঁটার ঝোপে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন কি না। … না, না, – এ প্রাণ-পোড়ানি আর সইতে পারিনে গো – আর সইতে পারিনে! হাঁ, তাঁর সঙ্গে দেখা করবই করব, একবার শেষ দেখা; তার পর বলব তাঁকে, – ‘ওগো, তোমার সে বেদৌরা আর নেই, – সে মরেছে, মরেছে। তার প্রাণ তোমারই সন্ধানে বেরিয়ে গিয়েছে! – তুমি তাকে বৃথা এমন করে খুঁজে বেড়াচ্ছ! বেদৌরা নেই – নেই – নেই।’
তার পর – তার পর? তার পরেও যদি তিনি আমায় চান, তা হলে কী বলব তাঁকে, কী করব তখন? – না, তখনও এমনই শক্ত কাঠ হয়ে বলব, – ‘ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না গো দেবতা, ছুঁয়ো না। আমার এ অপবিত্র দেহ ছুঁয়ে তোমার পবিত্রতার অবমাননা কোরো না!’
আঃ! মা গো! কী ব্যথা! বুকের ভিতরটা কে যেন ছুরি হেনে খান খান করে কেটে দিচ্ছে। …
আরও পড়ুন:
- ব্যথার দান গল্পগ্রন্থ | কাজী নজরুল ইসলাম
- কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী [ সংক্ষিপ্ত ] Kazi Nazrul Islam Biography [ Short ]
- রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম | অনুবাদ । কাজী নজরুল ইসলাম
- কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ তালিকা
- ব্যথার দান গল্পগ্রন্থ – কাজী নজরুল ইসলাম
- আমাদের শক্তি স্থায়ী হয় না কেন? প্রবন্ধ [ যুগবাণী ] কাজী নজরুল ইসলাম
- কালা আদমিকে গুলি মারা প্রবন্ধ [ যুগবাণী ] কাজী নজরুল ইসলাম