বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । চক্রবাক কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ১৯টি। এই কাব্যে নজরুল বেদনার ছবি তুুুলে ধরেছেন; এতে রয়েছে প্রেমের অনুুুভূতি এবং অতীত সুুখের স্মৃতিচারণা।
বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি কবিতা
বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী! ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হয়ে এল বিদায়ের রাতি! আজ হ'তে হ'ল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি, আজ হ'তে হ'ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি।... অস্ত-আকাশ-অলিন্দে তার শীর্ণ কপোল রাখি’ কাঁদিতেছে চাঁদ, "মুসাফির জাগো, নিশি আর নাই বাকি।" নিশীথিনী যায় দূর বন-ছায়, তন্দ্রায় ঢুলুঢুল্, ফিরে ফিরে চায়, দু’হাতে জড়ায় আঁধারের এলোচুল।-- চমকিয়া জাগি, ললাটে আমার কাহার নিশাস লাগে? কে করে বীজন তপ্ত ললাটে, কে মোর শিয়রে জাগে? জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক-তরুর সারি! তোমাদের আর আমার আঁখির পল্লব-কম্পনে সারা রাত মোরা কয়েছি যে কথা, বন্ধু, পড়িছে মনে!-- জাগিয়া একাকী জ্বালা ক'রে আঁখি আসিত যখন জল, তোমাদের পাতা মনে হ’ত যেনো সুশীতল করতল আমার প্রিয়ার!--তোমার শাখার পল্লবমর্মর মনে হ’ত যেন তারি কন্ঠের আবেদন সকাতর। তোমার পাতায় দেখেছি তাহারি আঁখির কাজল-লেখা, তোমার দেহেরই মতন দীঘল তাহার দেহের রেখা। তব ঝিরঝির মিরমির যেন তারি কুন্ঠিত বাণী, তোমার শাখায় ঝুলানো তারির শাড়ির আঁচলখানি। --তোমার পাখার হাওয়া তারি আঙ্গুলি-পরশের মত নিবিড় আদর-ছাওয়া! ভাবিতে ভাবিতে ঢুলিয়া পড়েছি ঘুমের শ্রান্ত কোলে, ঘুমায়ে স্বপন দেখেছি,-- তোমারি সুনীল ঝালর দোলে তেমনি আমার শিথানের পাশে। দেখেছি স্বপনে, তুমি গোপনে আসিয়া গিয়াছ আমার তপ্ত ললাট চুমি’। হয়ত স্বপনে রাড়ায়েছি হাত লইতে পরশখানি, বাতায়নে ঠেকি’ ফিরিয়া এসেছে, লইয়াছি লাজে টানি’। বন্ধু, এখন রুদ্ধ করিতে হইবে সে বাতায়ন! ডাকে পথ, হাঁকে যাত্রীরা, ‘কর বিদায়ের আয়োজন’। --আজি বিদায়ের আগে আমারে জানাতে তোমারে জানিতে কত কি যে সাধ জানে! মর্মের বাণী শূনি তব, শুধু মুখের ভাষায় কেন জানিতে চায় ও বুকের ভাষারে লোভাতুর মন হেন? জানি--মুখে মুখে হবে না মোদের কোনদিন জানাজানি, বুকে বুকে শুধু বাজাইবে বীণা বেদনার বীণাপাণি। হয়তো তোমারে দেখিয়াছি , তুমি যাহা নও তাই ক'রে, ক্ষতি কি তোমার, যদি গো আমার তাতেই হৃদয় ভরে? সুন্দর যদি করে গো তোমারে আমার আঁখির জল, হারা-মোমতাজে লয়ে কারো প্রেম রচে যদি তাজম'ল, --বল তাহে কার ক্ষতি? তোমারে লইয়া সাজাব না ঘর, সৃজিব অমরাবরী।।..
হয়ত তোমার শাখায় কখনো, বসেনি আসিয়া পাখী তোমার কুঞ্জে পত্রপুঞ্জে কোকিল ওঠেনি ডাকি'। শূন্যের পানে তুলিয়া ধরিয়া পল্লব-আবেদন জেগেছে নিশীথে জাগেনি ক' সাথে খুলি' কেহ বাতায়ন। -- সব আগে আমি আসি' তোমারে চাহিয়া জেগেছি নিশীথ, গিয়াছি গো ভালোবাসি! তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়-লেখা, এইটুকু হোক সান্ত্বনা মোর, হোক বা না হোক্ দেখা।... তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না। কোলাহল করি' সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না --নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।-- শুধাইতে নাই, তবুও শুধাই আজিকে যাবার আগে-- ঐ পল্লব-জাফ্রি খুলিয়া তুমিও কি অনুরাগে দেখেছ আমারে--দেখিয়াছি যবে তামি বাতায়ন খুলি'? হাওয়ায় না মোর অনুরাগে তব পাতা উঠিয়াছে দুলি'। তোমার পাতার হরিৎ আঁচলে চাঁদিনী ঘুমায়ে যবে, মূর্ছিতা হবে সুখের আবেশে,--সে আলোর উৎসবে মনে কি পড়িবে এই ক্ষণিকের অতিথির কথা আর? তোমার নিশ্বাস শূন্য এ ঘরে করিবে কি হাহাকার? চাঁদের আলোক বিস্বাদ কি গো লাগিবে সেদিন চোখে? খড়খড়ি খুলি' চেয়ে র'বে দূর অস্ত অলখ-লোকে?- --অথবা এমনি করি' দাঁড়ায়ে রহিবে আপন ধেয়ানে সারা দিনমান ভরি'? মলিন মাটির বন্ধনে বাঁধা হয় অসহায় তরু, পদতলে ধূলি, উর্দ্ধে তোমার শূন্য গগন-মরু। দিবসে পুড়িছ রৌদ্রের দাহে, নিশীথে ভিজিছ হিমে, কাঁদিবারও নাই শকতি, মৃত্যু-আফিসে পড়িছ ঝিমে! তোমার দুঃখ তোমারেই যদি, বন্ধু, ব্যথা না হানে, কি হবে রিক্ত চিত্ত ভরিয়া আমার ব্যথার দানে!... * * * ভুল করে' কভু আসিলে স্মরণে অমনি তা যেনো ভুলি'। যদি ভুল ক'রে কখনো এ মোর বাতায়ন যায় খুলি', বন্ধ করিয়া দিও পুনঃ তায়!.......তোমার জাফ্রি-ফাঁকে খুঁজো না তাহারে গগন-আঁধারে--মাটিতে পেলে না যাকে!
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- তোমারে পড়িছে মনে
- বাদল-রাতের পাখি
- স্তব্ধ রাতে
- বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি
- কর্ণফুলী
- শীতের সিন্ধু
- পথচারী
- মিলন-মোহনায়
- গানের আড়াল
- তুমি মরে ভুলিয়াছ
- হিংসাতুর
- বর্ষা-বিদায়
- সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে
- অপরাধ শুধু মনে থাক
- আড়াল
- নদীপারের মেয়ে
- ১৪০০ সাল
- চক্রবাক
- কুহেলিকা