পথচারী কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । চক্রবাক কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ১৯টি। এই কাব্যে নজরুল বেদনার ছবি তুুুলে ধরেছেন; এতে রয়েছে প্রেমের অনুুুভূতি এবং অতীত সুুখের স্মৃতিচারণা।
পথচারী কবিতা
কে জানে কোথায় চলিয়াছি ভাই মুসাফির পথচারি, দু'ধারে দু'কুল দুঃখ-সুখের--মাঝে আমি স্রোত-বারি! আপনার বেগে আপনি ছুটেছি জন্ম-শিখর হ'তে বিরাম-বিহীন রাত্রি ও দিন পথ হ'তে আন পথে! নিজ বাস হ'ল চির-পরবাস, জন্মের ক্ষন পরে বাহিরিনি পথে গিরি-পর্বতে--ফিরি নাই আর ঘরে। পলাতকা শিশু জন্মিয়াছিনু গিরি-কন্যার কোলে, বুকে না ধরিতে চকিতে ত্বরিতে আসিলাম ছুটে চ'লে। জননীরে ভুলি' সে পথে পলায় মৃগ-শিশু বাঁশী শুনি', যে পথে পলায় শশকেরা শুনি' ঝরনার ঝুনঝুনি, পাখী উড়ে যায় ফেলিয়া কুলায় সীমাহীন নভোপানে, সাগর ছাড়িয়া মেঘের শিশুরা পলায় আকাশ-যানে,-- সেই পথ ধরি' পলাইনু আমি! সেই হ'তে ছুটে চলি গিরি দরী মাঠ পল্লীর বাট সজা বাঁকা শত গলি। --কোন গ্রহ হ'তে ছিঁড়ি' উল্কার মত ছুতেছি বাহিয়া সৌর-লোকের সিঁড়ি! আমি ছুটে যাই জানিনা কোথায়, ওরা মোর দুই তীরে রচে নীড়, ভাবে উহাদেরি তীরে এসেছি পাহাড় চিরে। উহাদের বদূ কলস ভরিয়া নিয়ে যায় মোর বারি, আমার গহনে গাহন করিয়া বলে সন্তাপ-হারী! ঊহারা দেখিল কেবলি আমার সলিলের শিতলতা, দেখে নাই-জ্বলে কত চিতাগ্নি মোর কূলে কূলে কোথা! --হায়, কত হতভাগী-- আমিই কি জানি-- মরিল ডুবিয়া আমার পরশ মাগি'। বাজিয়াছে মোর তটে-তটে জানি ঘটে-ঘটে কিঙ্কিণী, জল-তরঙ্গে বেজেছে বধূর মধুর রিনিকি-ঝিনি। বাজায়েছে বেণু রাখাল-বালক তীর-তরুতলে বসি'। আমার সলিলে হেরিয়াছে মুখ দূর আকাশের শশী। জানি সব জানি, ওরা ডাকে মোরে দু'তীরে বিছায়ে স্নেহ, দীঘি হ'তে ডাকে পদ্মমুখীরা 'থির হও বাঁধি' গেহ!'
আমি ব'য়ে যাই- ব'য়ে যাই আমি কুলুকুলু কুলুকুলু শুনি না-- কোথায় মোরই তীরে হায় পুরনারী দেয় উলু! সদাগর-জাদী মণি-মাণিক্যে বোঝাই করিয়া তরী ভাসে মর জলে,-- "ছল ছল" ব'লে আমি দূরে যাই সরি'। আঁকড়িয়া ধরে' দু'তীর বৃথাই জড়ায়ে তন্তুলতা; ওরা দেখে নাই আবর্ত মোর, মোর অন্তর-ব্যথা! লুকাইয়া আসে গোপনে নিশীথে কূলে মোর অভাগিনী, আমি বলি 'চল ছল ছল ছল ওরে বধূ তোরে চিনি! কূল ছেড়ে আয় রে অভিসারিকা, মরণ-অকূলে ভাসি!' মোর তীরে-তীরে আজো খুঁজে ফিরে তোরে ঘর-ছাড়া বাঁশী। সে পড়ে ঝাঁপায়-জলে, আমি পথে ধাই--সে কবে হারায় স্মৃতির বালুকা-তলে! জানি না ক' হায় চলেছি কোথায় অজানা আকর্ষণে, চ'লেছি যতই তত সে অথই বাজে জল খনে খনে। সন্মুখ-টানে ধাই অবিরাম, নাই নাই অবসর, ছুঁইতে হারাই--এই আছে নাই-- এই ঘর এই পর! ওরে চল চল ছল ছল কি হবে ফিরায়ে আঁখি? তরি তীরে ডাকে চক্রবাকেরে তরি সে চক্রবাকী! ওরা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যায় কূলের কুলায়-বাসী, আঁচল ভরিয়া কুড়ায় আমার কাদায়-ছিটানো হাসি। ওরা চ'লে এক্যায়, আমি জাগি হায় ল'ইয়ে চিতাগ্নি শব, ব্যথা-আবর্ত মচড় খাইয়া বুকে করে কলরব! ওরে বেনোজল, ছল ছল ছল ছুটে চল ছুটে চল! হেথা কাদাজল পঙ্কিল তোরে করিতেছে অবিরল। কোথা পাবি হেথা লোনা আঁখিজল, চল চল পথচারী! করে প্রতীক্ষা তোর তরে লোনা সাত-সমুদ্র-বারি!
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- তোমারে পড়িছে মনে
- বাদল-রাতের পাখি
- স্তব্ধ রাতে
- বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি
- কর্ণফুলী
- শীতের সিন্ধু
- পথচারী
- মিলন-মোহনায়
- গানের আড়াল
- তুমি মরে ভুলিয়াছ
- হিংসাতুর
- বর্ষা-বিদায়
- সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে
- অপরাধ শুধু মনে থাক
- আড়াল
- নদীপারের মেয়ে
- ১৪০০ সাল
- চক্রবাক
- কুহেলিকা