দ্বারে বাজে ঝঞ্জার জিঞ্জির কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । সিন্ধু হিন্দোল কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা রয়েছে। কাব্যগ্রন্থটি “বাহার ও নাহার”-কে (হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শামসুন নাহার) উৎসর্গ করেন।

দ্বারে বাজে ঝঞ্জার জিঞ্জির কবিতা
দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জির, খোলো দ্বার ওঠো ওঠো বীর! নিদাঘের রৌদ্র খর কন্ঠে শোনে প্রদীপ্ত আহ্বান— জয় অভিনব যৌবন-অভিযান!... শ্রান্ত গত বরষের বিশীর্ণ শর্বরী স্থলিত মন্থর পদে দূরে যায় সরি বিরাটের চক্রনেমিতলে। চম্পমালা দোলাইয়া গলে আলোক-তাঞ্জামে আসে অভিযান-রথী, ঘুম-জাগা বিহগের কন্ঠে কন্ঠে আনন্দ-আরতি ভেসে চলে খেয়া-সম দিকে দিকে আজি। বজ্রাঘাতে ঘন ঘন আকাশ-কাঁসর ওঠে বাজি। মরমর-মঞ্জীর-পায়ে মাতে ঘূর্ণি-নটী বিশুষ্ক পল্লব-নৃত্যে, ডগমগ পড়িছে উছটি অসহ আনন্দ-মদে! সুন্দর আসিছে পিছে অবগাহি বেদনার জবা-রক্ত হ্রদে। ওড়ে তার ধূলি-রাঙা গৈরিক পতাকা বৈশাখের বাম করে! ক্ষত-চিহ্ন আঁকা নিখিল পীড়িত মুখে মুখচ্ছবি তার। একী রূপ হেরি তব বেদনার মুকুরে আমার অপরূপ! ওগো অভিনব! কত অশ্রু জমাইয়া কত দিনে গড়েছ এ তরবারি তব? সাঁতরিয়া কত অশ্রুজল, হে রক্ত-দেবতা মোর, পেলে আজি স্থল? কোন সে বেদনা-পানি বাণী অশ্রুমতী করিতেছে তোমার আরতি?
মন্দির-বেদির শ্বেত প্রস্তরের আস্তরণ তলে এলায়িত কুন্তলা কে স্খলিত অঞ্চলে ছিন্নপর্ণা স্থলপদ্ম-প্রায় প্রাণহীন দেবতার চরণে লুটায়? জানি, তারই স-বেদন আবেদনখানি খড়্গ হয়ে ঝলে তব করে, শস্ত্রপাণি! মরণ-উৎসবে রণে ক্রন্দন-বাসরে নিখিল-ক্রন্দসী, বীর, তব স্তব করে! বধূ তব নিখিলের প্রাণ বিদায়-গোধূলি-লগ্নে মৃত্যু-মঞ্চে করে মাল্য দান! ... হে সুন্দর, মোরা তব দূর যাত্রাপথ করিতেছি সহজ সরল, রচিতেছি তব ভবিষ্যৎ! সতেজ তরুণ কন্ঠে তব আগমনি গাহিতেছি রাত্রিদিন, দৃপ্ত জয়ধ্বনি ঘোষিতেছে আমাদের বাণী বজ্র-ঘোষ! বুকে বুকে জ্বালিতেছি বহ্নি-অসন্তোষ। আশার মশাল জ্বালি আলোকিয়া চলেছি আঁধার অগ্রদূত নিশান-বরদার! অতন্দ্রিত নিশীথ-প্রহরী—হাঁকিতেছি প্রহরে প্রহরে, যৌবনের অভিযান-সেনাদল, ওরে, ওঠ তোরা করি ত্বরা! তিমিরাবরণ খোলো, ছুঁড়ে ফেলো স্বপন-পসরা! ওঠো ওঠো বীর, দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জির! বিপ্লব-দেবতা ওই শিয়রে তোমার দাঁড়ায়েছ আসিয়া আবার! বারে বারে এসেছে দেবতা যুগান্তের এনেছে বারতা। বারে বারে করাঘাত করি দ্বারে দ্বারে হেঁকেছি প্রহরী নিদ্রাহীন রাত্রিদিন, আঘাতে ছিঁড়েছে তন্ত্রী, ভাঙিয়াছে বীণ; জাগিসনি তোরা, ফিরে গেছে দেবতা সুন্দর, এসেছে কুৎসিত মৃত্যু জরা। এবার দুয়ার ভাঙি শিয়রে দেবতা যদি আসিয়াছে পারাইয়া গিরি দরি সিন্ধু নদ নদী, ওরে চির-সুন্দরের পূজারির দল, এবার এ লগ্ন যেন না হয় বিফল! বারে বারে করিয়াছি যারে অপমান, মন্দির-প্রদীপ যারে বারে বারে করেছি নির্বাণ, বরণ করিতে হবে তারে। পলে পলে বিলাইয়া মোরা আপনারে যে আত্মদানের ডালা রেখেছি সাজায়ে তাই দান দিব রক্ত-দেবতার পায়ে! এবার পরান খুলে এ দর্প করিতে যেন পারি, জিতি আর হারি, ধরিয়াছি তোমার পতাকা—শুনিয়াছি তোমার আদেশ, আত্মবলি দিয়া দিয়া আপনারে করেছি নিঃশেষ! দাঁড়ায়েছি আসি তব পাশ শিরে ধরি অনির্বাণ জ্যোতিষ্কের উলঙ্গ আকাশ! বাহিরের রাজপথ বাহি, হে সারথি, চলিয়াছি তব রথ চাহি! আলোক-কিরণ করিয়াছি পান মোরা পুরিয়া নয়ন! — সুপ্তরাতে গুপ্তপথ বাহি, আসিয়াছে অসুন্দর শত্রুর সিপাহি, অকস্মাৎ পিছে হতে করেছে আঘাত।
মসিময় করিয়াছে তব রশ্মিপথ, নিন্দার প্রস্তর হানি রচেছে পর্বত, পথে পথে খুঁড়িয়াছে মিথ্যার পরিখা, চোখে-মুখে লিখিয়াছের ভন্ডামির নীতিবাণী লিখা, দলে দলে করিয়াছে রিরংসার উলঙ্গ চিৎকার, ফুঁ দিয়া নিবাতে গেছে, হে ভাস্কর, প্রদীপ তোমার! হে সুন্দর, মোরা শুধু তব অনুরাগে কোনো দিকে দেখি নাই, চলিয়াছি আগে লঙ্ঘি বাধা, লঙ্ঘিয়া নিষেধ, মানিনিকো কোরান পুরাণ শাস্ত্র, মানিনিকো বেদ! নির্বেদ তোমার ডাকে শুধু চলিয়াছি, যখনই ডেকেছ তুমি, হাঁকিয়াছি : ‘আছি, মোরা আছি!’ ভরি তব শুভ্র শুচি ললাট-অঙ্গন কলঙ্ক-তিলক-পঙ্ক করেছে লেপন, বারে বারে মুছিয়াছিল, প্রিয় ওগো প্রিয়, তোমার ললাট-পঙ্কে ম্লান হল আমাদের রক্ত-উত্তরীয়! জাদুকর মিথ্যুকের সপ্তসিন্ধুনীর কত দিনে হব পার, পাব শভ্র আনন্দের তীর? হে বিপ্লব-সেনাধিপ, হে রক্ত-দেবতা, কহো, কহো কথা! শ্মশানের শিবা-মাঝে হে শিব সুন্দর এসো এসো, দাও তব চরম নির্ভর! দাও বল, দাও আশা, দাও তব পরম আশ্বাস, হিংসুকের বদ্ধদ্বার জতুগৃহে আনো অবকাশ! অপগত হোক এ-সংশয়, দশদিকে দিগঙ্গনা গেয়ে যাক যৌবনের জয়! অসুন্দর মিথ্যুকের হোক পরাজয়, এসো এসো আনন্দ-সুন্দর, জাগো জ্যোতির্ময়!

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ
- গোপন প্রিয়া
- অনামিকা
- বিদায় স্মরণে
- পথের স্মৃতি
- উন্মনা
- অতল পথের যাত্রী
- দারিদ্র্য
- বাসন্তি
- ফাল্গুনী
- মঙ্গলাচরণ
- বধু-বরণ
- অভিযান
- রাখী-বন্ধন
- চাঁদনী-রাতে
- মাধবী-প্রলাপ
- দ্বারে বাজে ঝঞ্জার জিঞ্জির