ছুতমার্গ যুগবাণী প্রবন্ধ কাজী নজরুল ইসলাম : একবার এক ব্যঙ্গ-চিত্রে দেখিয়াছিলাম, ডাক্তারবাবু রোগীর টিকি-মূলে স্টেথিস্কোপ বসাইয়া জোর গ্রাম্ভারি চালে রোগ নির্ণয় করিতেছেন! আমাদের রাজনীতির দণ্ডমুণ্ড হর্তা-কর্তা-বিধাতার দলও আমাদের হিন্দু-মুসলমানের প্রাণের মিল না হওয়ার কারণ ধরিতে গিয়া ঠিক ওই ডাক্তারবাবুর মতোই ভুল করিতেছেন। আদত স্পন্দন যেখান যেখান হইতে প্রাণের গতি-রাগ স্পষ্ট শুনিতে পাওয়া যায়, সেখানে স্টেথিস্কোপ না লাগাইয়া টিকি-মূলে যদি ব্যামো নির্ণয় করিতে চেষ্টা করা হয়, তাহা হইলে তাহা যেমন হাস্যাস্পদ ও ব্যর্থ, রাজনীতির দিক দিয়া হিন্দু-মুসলমানের প্রাণের মিলনের চেষ্টা করাও তেমনই হাস্যস্পদ ও ব্যর্থ। সত্যিকার মিলন আর স্বার্থের মিলনে আশমান জমিন তফাত।
ছুতমার্গ যুগবাণী প্রবন্ধ কাজী নজরুল ইসলাম
প্রাণে প্রাণে পরিচয় হইয়া যখন দুইটি প্রাণ মানুষের গড়া সমস্ত বাজে বন্ধনের ভয়-ভীতি দূরে সরাইয়া সহজ সংকোচে মিশিতে পারে, তখনই সে মিলন সত্যিকার হয়; আর যে মিলন সত্যিকার, তাহাই চিরস্থায়ী, চিরন্তন। কোনো একটা বিশেষ কার্য উদ্ধারের জন্য চির-পোষিত মনোমালিন্যটাকে আড়াল করিয়া বাহিরে প্রাণভরা বন্ধুত্বের ভান করিলে সে-বন্ধুত্ব স্থায়ী তো হইবেই না, উপরন্তু সে-স্বার্থও সিদ্ধ না হইতে পারে, কেননা মিথ্যার উপর ভিত্তি করিয়া কখনও কোনো কার্যে পূর্ণ সাফল্যলাভ হয় না।
এখন কথা হইতেছে, আদত রোগ কোথায়? আমাদের গভীর বিশ্বাস যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলনের প্রধান অন্তরায় হইতেছে এই ছোঁয়া-ছুঁয়ির জঘন্য ব্যাপারটাই। ইহা যে কোনো ধর্মেরই অঙ্গ হইতে পারে না, তাহা কোনো ধর্ম সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান না থাকিলেও আমরা জোর করিয়াই বলতে পারি। কেননা একটা ধর্ম কখনও এত সংকীর্ণ অনুদার হইতেই পারে না। ধর্ম সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সত্য চিরদিনই বিশ্বের সকলের কাছে সমান সত্য।
এইখানেই বুঝা যায় যে, কোনো ধর্ম শুধু কোনো এক বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য নয়, তাহা বিশ্বের। আর এই ছুতমার্গ যখন ধর্মের অঙ্গ নয়, তখনই নিশ্চয়ই ইহা মানুষের সৃষ্টি বা খোদার [উপর] খোদকারি। মানুষের সৃষ্টি-শৃঙ্খলা বা সমাজ-বন্ধন সাময়িক সত্য হইতে পারে, কিন্তু তাহা তো শাশ্বত সত্য হইতে পারে না। এই জন্যই ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’ রূপ মহাবাণীর উৎপত্তি। আমাদেরও হাদিসে সেই জন্য প্রতি শতবর্ষে একজন করিয়া ‘মুজাদ্দিদ’ বা সংস্কারক আসেন বলিয়া লিখিত আছে। ‘বেদাৎ’ বা মানুষের সৃষ্ট রাজনীতির সংস্কার করাই এই সংস্কারকদের মহান লক্ষ্য।
হিন্দুধর্মের মধ্যে এই ছুতমার্গরূপ কুষ্ঠরোগ যে কখন প্রবেশ করিল তাহা জানি না, কিন্তু ইহা যে আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃদের মতো একটা বিরাট জাতির অস্থিমজ্জায় ঘুণ ধরাইয়া একেবারে নিবীর্য করিয়া তুলিয়াছে, তাহা আমরা ভাইয়ের অধিকারের জোরে জোর করিয়া বলিতে পারি। আমরা যে তাঁহাদের সমস্ত সামাজিক শাসনবিধি একদিনেই উলটাইয়া ফেলিতে বলিতেছি, তাহা নয়, কিন্তু যে সত্য হয়তো একদিন সামাজিক শাসনের জন্যেই শৃঙ্খলিত হইয়াছিল, তাহার কী আর মুক্তি হইবে না?
বাংলার মহাপ্রাণ মহাতেজস্বী, পুত্র, স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছেন যে, ভারতে যেদিন হইতে এই ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটার উৎপত্তি সেদিন হইতেই ভারতের পতন, মুসলমান আগমনে নয়! মানুষকে এত ঘৃণা করিতে শিখায় যে ধর্ম, তাহা আর যাহাই হউক ধর্ম নয়, ইহা আমরা চ্যালেঞ্জ করিয়া বলিতে পারি। এই ধর্মেই নর-কে নারায়ণ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। কী উদার সুন্দর কথা! মানুষের প্রতি কী মহান পবিত্র পূজা! আবার সেই ধর্মেরই সমাজে মানুষকে কুকুরের চেয়েও ঘৃণ্য মনে করিবার মতো হেয় জঘন্য এই ছুতমার্গ বিধি!
কী ভীষণ অসামঞ্জস্য! আমাদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত দহনপূত কালাপাহাড়ের দলকে সেই জন্য আমরা আজ প্রাণ হইতে আবাহন করিতেছি, এই মান্ধাতার আমলের বিশ্রী বিধি-বন্ধন ভাঙিয়া চুরমার করিয়া ফেলিতে, ‘আয়রে নবীন, আয়রে আমার কাঁচা! আমরা যে ধর্মটাকেই একেবারে উড়াইয়া দিতে চাহিতেছি, ইহা মনে করিলে আমাদের ভুল বুঝা হইবে। আমরা অন্তর হইতেই বলিতেছি যে, আমাদিগকে সীমার মাঝে থাকিয়াই অসীমের সুর বাজাইতে হইবে। নিজের ধর্মকে মানিয়া লইয়া সকলকে প্রাণ হইতে দু-বাহু বাড়াইয়া আলিঙ্গন করিবার শক্তি অর্জন করিতে হইবে।
যিনি সত্যিকারভাবে স্বধর্মে নিষ্ঠ, তাঁহার এই উদার বিশ্বপ্রেম আপনা হইতেই আসে। যত ছোঁয়া-ছুঁয়ির নীচ ব্যবহার ভণ্ড বক-ধার্মিক আর বিড়ালী-তপস্বী দলের মধ্যেই। ইহাদের এই মিথ্যা মুখোশ খুলিয়া ফেলিয়া ইহাদের অন্তরের বীভৎস নগ্নতা সমাজের চোখের সম্মুখে খুলিয়া ধরিতে হইবে। এইখানে একটা গল্প মনে পড়িয়া গেল। একদিন আমরা এক ট্রেনে গিয়া উঠিলাম। আমাদের কামরায় মালা-চন্দনধারী অনেকগুলি হিন্দু ভদ্রলোক ছিলেন। আমরা কামরায় প্রবেশ করিবামাত্র অর্থাৎ আমাদের মাথায় টুপি ও পগ্গ দেখিয়াই ছোঁয়া যাইবার ভয়ে তাঁহারা তটস্থ হইয়া অন্য দিকে গিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।
সেই বেঞ্চেরই এক প্রান্তে বসিয়া এক পণ্ডিতজি বেদ ও ওইরূপ কোনো শাস্ত্র-গ্রন্থ পাঠ করিয়া ওই ভদ্রলোকদের শুনাইতেছিলেন। তিনি আমাদের দেখিয়াই এবং আমাদের অপ্রতিভ ভাব দেখিয়া হাসিয়া আমাদের হাত ধরিয়া সাদরে নিজের পার্শ্বে বসাইলেন। ভদ্রলোকদের চক্ষু ততক্ষণে কাণ্ড দেখিয়া চড়ক গাছ। আমরাও তখন সহজ হইয়া পণ্ডিতজিকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, তিনি পণ্ডিত ও আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণকুলতিলক হইয়াও কী করিয়া আমাদিগকে এমন করিয়া আলিঙ্গন করিতে পারিলেন, অথচ এই ভদ্রলোকগণ আমাদিগকে দেখিয়া কেন একেবারে দশ হাত লাফাইয়া উঠিলেন?
ইহাতে তিনি হাসিয়া বলিলেন, “দেখ বাবা, আমি হিন্দু ধর্মকে ভালোবাসি ও সত্য বলিয়া জানি বলিয়া বিশ্বের সকলকে, সকল ধর্মকে ভালোবাসিতে শিখিয়াছি। আমার নিজের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস আছে বলিয়াই অন্য সকলকে বিশ্বাস করিবার ও প্রাণ দিয়া আলিঙ্গন করিবার শক্তি আমার আছে। যাহারা অন্য ধর্মকে ও অন্য মানুষকে ঘৃণা করে বা নীচ ভাবে, তাহারা নিজেই অন্তরে নীচ, তাহাদের নিজেরও কোনো ধর্ম নাই। তবে ধর্মের যে ঘটাটা দেখ, তাহা অন্তরের দীনতা-হীনতা ঢাকিবার ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র!” ইহা বানানো গল্প নয়, সত্য ঘটনা।
আরও পড়ুন :
- কাজী নজরুল ইসলামের চিঠি -পত্র
- কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ তালিকা সূচি
- কাজী নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি [ GLive ]
- নজরুল সঙ্গীত [ সঙ্গীত গুরুকুলে]
- আমার নজরুল [ সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর]
- আমার প্রিয় কবি নজরুল রচনা [ বাংলা গুরুকুল ]