কবিতায় একটা আবহমান বিতর্ক আছে—‘ক্লাস’ না ‘মাস’? যিনি ‘ক্লাস’ তিনি ‘মাস’-এর নন, যিনি ‘মাস’ তিনি ‘ক্লাস’-এর নন। নজরুল এই উপমহাদেশের একমাত্র কবি, যিনি ‘ক্লাস’ এবং ‘মাস’ দু’দলের বাজারই জমজমাট করে রেখেছেন একশো বছর।
নজরুলের কেউ জাত মারতে পারেনি, তাঁর জাতের নাম ভালবাসা।
তাঁর হৃদয়পুরে কোনও জটিলতার খেলা চলেনি, তিনি মন্দির এবং মসজিদের মাঝখানে একটা গাছতলাকে ভারতবর্ষ বানিয়ে নিয়েছিলেন, সেই গাছতলায় বসে একটার পর একটা পান মুখে দিচ্ছেন, চা খাচ্ছেন, চা শেষ করে আবার পান মুখে দিচ্ছেন আর তাঁর মুখ থেকে অনর্গল গান বেরিয়ে আসছে, তাঁকে কাগজ কলম এগিয়ে দিলেই কবিতা লিখে দিচ্ছেন।
এই রকম কবিপ্রতিভা, এই রকম ভলক্যানো এই উপমহাদেশ আগে দেখেনি, পরেও দেখেনি আর।
একটি কবিতা, শুধু একটি কবিতা লিখে কেউ যে হাইড্রোজেন বোমা ফেলতে পারেন, বাঙালির জানা ছিল না।
এমন একটি কবিতা যা একশো বছর ধরে রক্ত গরম করে চলেছে।
যে মাটিতে পড়বে সেখানে সোনা ফলাবে।
যে পাথরে রাখবে পাথর ফেটে যাবে।
যে জলে গিয়ে নামবে, সেখানে জলপ্রপাত হবে।
একটা কবিতা একা এত শক্তিমান হতে পারে আগে জানা ছিল না।
একটা কবিতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হেড-অফিসের চেয়েও শক্তিমান হতে পারে সেটা বুঝতে পারলাম আমরা যখন আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে শুনলাম, ‘বল বীর— বল উন্নত মম শির’।
‘বিদ্রোহী’ এমন একটা কবিতা যেখান থেকে সেই কবিতা শুরু হল যা আজকেও ‘প্রোটেস্ট কবিতা’ হিসেবে আমরা পড়ে চলেছি।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য নজরুল জেলে যাননি। কারার ঐ লৌহকপাট-এর জন্যও কারাবরণ করেননি, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’-র জন্যও তাঁর নামে ওয়ারেন্ট বার হয়নি।
কিন্তু ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য নজরুলের জেল হয়েছিল। কী ছিল সেই কবিতায়?
তিনি দেবী দুর্গাকে বলছেন মাটির ঢেলা থেকে বেরিয়ে এসে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে শোষণের অত্যাচার থেকে ভারতকে বাঁচাতে।
দুর্গাকে নিয়ে, আনন্দময়ীকে নিয়ে এ রকম ‘অখণ্ড ভারতী মানস’-এর কবিতা, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ‘আনখ সমুদ্দুর’ উঠে দাঁড়ানো কবিতা আর কেউ লেখেননি:
“আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল
দেবশিশুদের মারছে চাবুক বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?”
এই কবিতা সহ্য করতে না পেরে ইংরেজ-লোভী কিছু বাঙালিই ধরিয়ে দিয়েছিল নজরুলকে। বহরমপুরের জেল থেকে নজরুল লিখলেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’।
ভিতরের একটি পৃষ্ঠায় লিখলেন ‘আমি লাভের বশবর্তী হয়ে আমার আত্মোপলব্ধি বিক্রয় করি নাই’।
সেই বহরমপুরের মানুষ বলত, নজরুল জেলে বসে গান গাইছে, বাইরে সারা মুর্শিদাবাদ, সারা বাংলা সেই গান শুনছে। এটা কি দ্বিতীয় নোবেল প্রাইজ় নয়?
ধূমকেতু পত্রিকায় ১৯২২-এর ১৩ অক্টোবর নজরুল আর একটি বোমা ফেললেন:
“স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন।
ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনও বিদেশীর মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।
যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন,
তাদেরকে পাততাড়ি গুটিয়ে, কোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে।
প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তারা শুনবেন না।
তাদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো।
আমাদেরো এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।”
এই আসল কথাগুলো মুখে বললেও কারও ক্ষমতা ছিল না লিখে ফেলার। নজরুল সেটা করলেন। ঔপনিবেশিক শাসনকে যেমন কাঁপিয়ে দিলেন, তেমনই বহু রথী মহারথীর ঘুম কেড়ে নিলেন।
যাঁরা উচ্চাসনে বসে ইংরেজ শাসকের থেকে সুবিধা পাচ্ছেন, তাঁদের কী আর ভাল লাগে নজরুল নামক এক ছোকরা কবির জ্বালাময়ী সত্যভাষণ।
১৯২৬ সালের দাঙ্গা দেখে নজরুল ভয়ঙ্কর কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি দু’টি প্রবন্ধ লেখেন, ‘মন্দির ও মসজিদ’ এবং ‘হিন্দু-মুসলমান’।
তিনি লিখছেন, “হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না,
মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না।…
রক্তে তাহাদের বেদী চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল।”
কিন্তু তাঁর স্বপ্ন দেখার সাহস দেখে আজকেও অবাক লাগে,
“সেই রুদ্র আসিতেছেন, যিনি ধর্ম-মাতালদের আড্ডা ঐ মন্দির মসজিদ গির্জা ভাঙিয়া সকল মানুষকে এক আকাশের গম্বুজতলে লইয়া আসিবেন।”
যে ভারতবর্ষের আকাশ তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন, সেই আকাশ আমরা পাইনি।
কেন পাব? আমরা কি সেই আকাশের জন্য নজরুলের ভাবনার কাছে যেতে পেরেছি?
নজরুল যখন পুত্রশোকে বিহ্বল, তখন তিনি নিমতিতার যোগী পুরুষ বরদাচরণ মজুমদারের সংস্পর্শে এসে কালী পুজো শুরু করেন।
নজরুল যত শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন, তত গান আর কোনও কবি রচনা করেননি।
জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, যিনি জ্ঞান গোসাঁই নামে অধিক পরিচিত ছিলেন, নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ড করেন।
লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল সে গান,
‘বল্ রে জবা বল্—
কোন্ সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল”,
বা “কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন”।
১৯২৬ সালে নজরুল ইসলাম কৃষ্ণনগরে বিশিষ্ট বিপ্লবী হেমন্ত সরকারের বাড়িতে বেশ কিছু দিন সপরিবারে থাকেন। সেখানে সে বছর তিনি কালীপুজো করেন। গান লেখেন,
“মোর লেখাপড়া হল না মা
আমি ম দেখিতেই দেখি শ্যামা
আমি ক লিখিতেই কালী বলে
(মা) নাচি দিয়ে করতালি।”
নজরুলের ‘মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়’ বা ‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’ বা ‘মন জপ রাম, শ্রীরঘুপতি রাম’ গানের আবেদন ছুঁয়ে যায় মর্মে।
এটাও পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা, একজন প্রেমিক অ-হিন্দু সাধক এত শ্যামাসঙ্গীত লিখছেন।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সেই সাম্যচিন্তায় বিশ্বমানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে।
তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন:
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান।’
মানুষকে সমভালোবাসায়, সমশ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূলকথা।
এই শ্রদ্ধা, এই মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়।
অতি জোরালো ভাবে তিনি বলেছেন:
❝ হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছো মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কণ্টক মুকুট শোভা।
দিয়াছ তাপস, অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস। ❞
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে।
এই সমতা বোধ তুলনাহীন।
বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘আমার জবানবন্দীতে’ও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়— বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীদের মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে।
ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে:
‘তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তার পাওনা কড়ায়-গন্ডায় বুঝিয়ে দিতে হবে:
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’
সতত রহস্যময় এক পুরুষ, নাগরিক শিক্ষা বঞ্চিত, অভাব অনটনে বেড়ে ওঠা, ব্রিটিশদের ‘বাঙালি ফৌজে’ যোগদান, হিন্দু-পুরাণ কাব্যের প্রতি গভীর অনুরাগ, বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী, রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রিয়, চির-অস্থির মনোভাবাপন্ন নজরুলকে জানা যায় না, তাঁকে অনুধাবন করতে হয়।
নজরুল চর্চা শানিত হোক। উদ্ঘাটিত হোক নজরুল মাহাত্ম্য।
নজরুলের ধর্মচেতনা প্রতিষ্ঠিত হোক সর্বময়।
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
লেখক : অপূর্ব গুপ্ত
আরও দেখুন: