কবি নজরুলের নাট্যগ্রন্থ ও নাট্যপ্রাসঙ্গিক গ্ৰন্থসমূহ নিয়ে আজকের আলোচনা। নজরুল রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে আলেয়া, মধুমালা, বিদ্যাপতি, পুতুলের বিয়ে, জাগো সুন্দর চির কিশোর, শ্রীমন্ত, বিষ্ণুপ্রিয়া, বনের বেদে, ঝিলিমিলি, সেতু–বন্ধ, ভূতের ভয় ইত্যাদি। কলকাতার সুধী ও নাট্যমহলে নজরুল নাট্যকার হিসেবে পরিচিত হন ‘নওরোজ’ পত্রিকার মাধ্যমে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে (১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) নজরুলের তিনটি একাংকিকা নিয়ে ‘ঝিলিমিলি’ নামে নাট্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
কবি নজরুলের নাট্যগ্রন্থ ও নাট্যপ্রাসঙ্গিক গ্ৰন্থসমূহ
নজরুলের নাট্যগ্রন্থ ও নাট্যপ্রাসঙ্গিক গ্রন্থ:
১. ঝিলিমিলি (একাঙ্ক–সংকলন)
- প্রকাশকাল: অগ্রহায়ণ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ (নভেম্বর ১৯৩০)
- বিবরণ: এই সংকলনে তিনটি একাঙ্ক নাটক—‘ঝিলিমিলি’, ‘সেতুবন্ধ’ ও ‘শিল্পী’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তী সংস্করণে ‘ভূতের ভয়’ নামক একটি অতিরিক্ত একাঙ্ক নাটক সংযোজিত হয়।
- বৈশিষ্ট্য: নজরুলের এই নাটকগুলোতে সামাজিক বাস্তবতা, মানবিক সম্পর্ক এবং রোমান্টিক আবেগের সংমিশ্রণ দেখা যায়। ‘ভূতের ভয়’ নাটকটি হাস্যরসাত্মক উপাদানে সমৃদ্ধ, যা তৎকালীন বাংলা নাট্যসাহিত্যে একটি নতুন দিক উন্মোচন করে।
২. মহুয়ার গান
- প্রকাশকাল: জানুয়ারি ১৯৩০
- বিবরণ: মন্মথ রায়ের ‘মহুয়া’ নাটকের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম এই গানগুলো রচনা করেন।
- বৈশিষ্ট্য: এই গীতিনাট্যে নজরুল বাংলা লোকসংগীতের ধারা ও শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগের সমন্বয়ে গান রচনা করেন, যা নাটকের আবেগ ও পরিবেশকে গভীরতা প্রদান করে।
৩. আলেয়া (গীতিনাট্য)
- প্রকাশকাল: ১৯৩১
- মঞ্চায়ন: নাট্যনিকেতন কর্তৃক পৌষ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে মঞ্চস্থ হয়।
- বৈশিষ্ট্য: ‘আলেয়া’ গীতিনাট্যটি সামাজিক ও রোমান্টিক থিমে রচিত, যেখানে নজরুলের সুর ও বাণীর সমন্বয়ে নাট্যগীতি নতুন মাত্রা পায়।
৪. পুতুলের বিয়ে
- প্রকাশকাল: চৈত্র ১৩৪০ বঙ্গাব্দ (১৯৩৩)
- বিবরণ: শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত এই একাঙ্ক নাটকটি তাদের মানসিক বিকাশ ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত।
- বৈশিষ্ট্য: নজরুলের এই রচনায় শিশুদের কল্পনা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার জন্য সহজ ভাষা ও ছন্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
৫. বিদ্যাপতি (রেকর্ড–নাট্য)
- প্রকাশকাল: হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানীর মাসিক পুস্তিকায় প্রকাশিত
- বিবরণ: এই রেকর্ড-নাট্যটি বিদ্যাপতি চরিত্রের উপর ভিত্তি করে রচিত, যেখানে নজরুল প্রাচীন কবি বিদ্যাপতির জীবন ও কাব্যিক অবদানকে নাট্যরূপে উপস্থাপন করেন।
- বৈশিষ্ট্য: নজরুলের সুর ও বাণীর মাধ্যমে বিদ্যাপতির প্রেম ও ভক্তির কবিতাগুলো নতুন রূপে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
৬. ধনের বেদে (রেকর্ড–নাট্য)
- মঞ্চায়ন: মেগাফোন ড্রামাটিক অ্যাট কর্তৃক অভিনীত
- বিবরণ: এই নাটকটি বেদে সম্প্রদায়ের জীবন ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে রচিত, যেখানে নজরুল তাদের সামাজিক অবস্থান ও সংগ্রামকে নাট্যরূপে উপস্থাপন করেন।
- বৈশিষ্ট্য: নজরুলের এই রচনায় বেদে সম্প্রদায়ের সংগীত ও নৃত্যশৈলীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা নাটকটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
৭. আলেয়া ও ঝিলিমিলি (দুটি গ্রন্থ একত্রে)
- বিবরণ: এই সংকলনে ‘আলেয়া’ ও ‘ঝিলিমিলি’ নাটক দুটি একত্রে প্রকাশিত হয়েছে, যা পাঠকদের জন্য নজরুলের নাট্যসাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহ উপস্থাপন করে।
৮. মধুমালা (নাটক)
- প্রকাশকাল: ১৯৫৮
- প্রকাশক: ভারতী লাইব্রেরি, কলকাতা
- ভূমিকা: ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
- বিবরণ: ‘মধুমালা’ একটি রোমান্টিক নাটক, যেখানে নজরুল প্রেম, বিরহ ও মানবিক সম্পর্কের সূক্ষ্মতা তুলে ধরেছেন।
- বৈশিষ্ট্য: নজরুলের কাব্যিক ভাষা ও সুরের ব্যবহার নাটকটিকে একটি সংগীতনাট্যে রূপান্তরিত করেছে।
৯. উদাসী ভৈরব (গীতিনাটিকা)
- প্রকাশকাল: ১৯৯১
- প্রকাশক: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি, কলকাতা
- বিবরণ: এই গীতিনাটিকাটি কাজী নজরুল ইসলামের হস্তলিখিত রচনার উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তিনি নতুন রাগ ‘উদাসী ভৈরব’ সৃষ্টি করে গান রচনা করেছেন।
- বৈশিষ্ট্য: নজরুলের এই সৃষ্টিতে রাগসংগীতের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, যা বাংলা সংগীতের জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
নজরুলের নাটক দর্শককে দেখিয়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে এমনকি বিপ্লবে, যুদ্ধে, স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। দেশাত্মবোধের জাগরণ ও মহত্তর কল্যাণবোধের উত্তোরণের জন্যে, উপেক্ষিত লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত আত্মবিস্মৃত ব্যক্তিকে চেতনাসম্পন্ন করতে চেয়েছে নজরুলের নাটক। চিরঞ্জীব হোক নজরুলের নাট্যসাহিত্য।

আরও দেখুনঃ