আলো আঁধারি কবিতা টি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । মরুভাস্কর কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। হজরত মোহাম্মদ সঃ এর জীবনী নিয়ে চারটি সর্গে ১৮ টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ।
আলো আঁধারি কবিতা
সব-কনিষ্ঠ পুত্র সে প্রিয় আবদুল্লার শোকে,
সেদিন নিশীথে ঘুম নাকো মুত্তালিবের চোখে!
পঁচিশ বছর ছিল যে পুত্র আঁখির পুতলা হয়ে,
বৃদ্ধ পিতারে রাখিয়া মৃত্যু তারেই গেল কি লয়ে!
হয়ে আঁখিজল ঝরে অবিরল পঁচিশ-বছরি স্মৃতি,
সে স্মৃতির ব্যথা যতদিন যায় তত বাড়ে হায় নিতি!
বাহিরে ও ঘরে বক্ষে নয়নে অশ্রুতে তারে খোঁজে
সহসা বিধবা আমিনারে হেরি সভয়ে চক্ষু বোজে!
ওরে ও অভাগি, কে দিল ও বুকে ছড়ায়ে সাহারা-মরু?
অসহায় লতা গড়াগড়ি যায় হারায়ে সহায়-তরু!
আঙনে বেড়ায় ও যেন রে হায় শোকের শুভ্রশিখা,
রজনিগন্ধা বিধবা মেয়েরে লয়ে কাঁদে কাননিকা!
মন্থরগতি বেদনা-ভারতী আমিনা আঙনে চলে,
হেরিতে সহসা মুত্তালিবের আঁধার চিত্ততলে
ঈষৎ আলোর জোনাকি চমকি যায় যেন ক্ষণে ক্ষণে,
আবদুল্লার স্মৃতি রহিয়াছে ওই আমিনার সনে।
আসিবে সুদিন আসিবে আবার, পুত্রে যে ছিল প্রাণ
পুত্র হইতে পৌত্রে আসিয়া হবে যে অধিষ্ঠান।
দিন গোনে মনে মনে আর কয়, ‘বাকি আর কত দিন,
লইয়া অ-দেখা পিতার স্মৃতিরে আসিবি পিতৃহীন!’
মুত্তালিবের আঁধার চিত্তে জ্বলেছে সহসা বাতি,
সেদিন আসিবে যেন শেষ হলে আজিকার এই রাতি!
চোখে ঘুম নাই শূন্যে বৃথাই নয়ন ঘুরিয়া মরে,–
নিশি-শেষে যেন অতন্দ্র চোখে তন্দ্রা আসিল ভরে!
কত জাগে আর লয়ে হাহাকার, আঁধারের গলা ধরি
আর কতদিন কাঁদিবে গো, চোখে অশ্রু গিয়াছে মরি!
আয় ঘুম হায়, হয়তো এবার স্বপনে হেরিব তারে,
বিরাম-বিহীন জাগি নিশিদিন খুঁজিয়া পাইনি যারে!
হেরিল মুত্তালিব অপরূপ স্বপ্ন তন্দ্রা-ঘোরে,–
অভূতপূর্ব আওয়াজ যেন গো বাজিছে আকাশ ভরে!
ফেরেশতা সব যেন গগনের নীল শামিয়ানা-তলে
জমায়েত হয়ে তকবীর হাঁকে, সে আওয়াজ জলে থলে
উঠিল রণিয়া। ‘সাফা’ ‘মারওয়ান’ গিরি-যুগ সে আওয়াজে
কাঁপিতে লাগিল, উঠিল আরাব, ‘আসিল সে ধরা মাঝে!’
কে আসিল ? সে কী আমিনার ঘরে? ছুটিতে ছুটিতে যেন
আসিল যে ঘরে আমিনা! ওকি ও, গৃহের ঊর্ধ্বে কেন
এত সাদা মেঘ ছায়া করে আছে? শত স্বর্গের পাখি
বসিতেছে ওই গেহ-পরি যেন চাঁদের জোছনা মাখি!
ঝুঁকিয়া ঝুঁকিয়া দেখিছে কী যেন গ্রহ তারাদল আসি
আকাশ জুড়িয়া নৌবত বাজে ভুবন ভরিয়া বাঁশি!…
টুটিল তন্দ্রা মুত্তালিবের অপরূপ বিস্ময়ে –
ছুটিল যথায় আমিনা – হেরিল নিশি আসে শেষ হয়ে।
আমিনার শ্বেত ললাটে ঝলিত যে দিব্য জ্যোতি-শিখা,
কোলে সে এসেছে – হাতে চাঁদ তার ভালে সূর্যের টিকা!
সে রূপ হেরিয়া মুর্ছিত হয়ে পড়ল মুত্তালিব,
একী রূপ ওরে একী আনন্দ একী এ খোশনসিব!
চেতনা লভিয়া পাগলের প্রায় কভু হাসে কভু কাঁদে,
যত মনে পড়ে পুত্রে, পৌত্রে তত বুকে লয়ে বাঁধে!
পৌত্রে ধরিয়া বক্ষে তখনই আসিলেন কাবা-ঘরে,
বেদি পরে রাখি শিশুরে করেন প্রার্থনা শিশু তরে।
‘আরশে’ থাকিয়া হাসিলেন খোদা – নিখিলের শুভ মাগি
আসিল যে মহামানব – যাচিছে কল্যাণ তারই লাগি!
ছিল কোরেশের সর্দার যত সে প্রাতে কাবায় বসি
যোগ দিল সেই ‘মুনাজাতে’ সবে আনন্দে উচ্ছ্বসি।
সাতদিন যবে বয়স শিশুর – আরবের প্রথামতো
আসিল ‘আকিকা’ উৎসবে প্রিয় বন্ধু স্বজন যত!
উৎসব শেষে শুধাল সকলে শিশুর কী নাম হবে,
কোন সে নামের কাঁকন পরায়ে পলাতকে বাঁচি লবে।
কহিল মুত্তালিব বুকে চাপি নিখিলের সম্পদ,–
“নয়নাভিরাম! এ শিশুর নাম রাখিনু ‘মোহাম্মদ’!”
চমকে উঠিল কোরেশির দল শুনি অভিনব নাম,
কহিল, ‘এ নাম আরবে আমরা প্রথম এ শুনিলাম।
বনি-হাশেমের গোষ্ঠীতে হেন নাম কভু শুনি নাই,
গোষ্ঠী-ছাড়া এ নাম কেন তুমি রাখিলে, শুনিতে চাই!’
আঁখিজল মুছি চুমিয়া শিশুরে কহিলেন পিতামহ –
“এর প্রশংসা রণিয়া উঠুক এ বিশ্বে অহরহ,
তাই এরে কহি ‘মোহাম্মদ’ যে চির-প্রশংসমান,
জানি না এ নাম কেন এল মুখে সহসা মথিয়া প্রাণ।”
নাম শুনি কহে আমিনা –‘স্বপ্নে হেরিয়াছি কাল রাতে
‘আহ্মদ’ নাম রাখি যেন ওর!’ ‘জননী, ক্ষতি কি তাতে’
হাসিয়া কহিল পিতামহ, ‘এই যুগল নামের ফাঁদে,
বাঁধিয়া রাখিনু কুটিরে মোদের তোমার সোনার চাঁদে!’
একটি বোঁটায় ফুটিল গো যেন দুটি সে নামের ফুল,
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অ কিঞ্চিত কর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জন প্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্ত র্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
প্রথম সর্গ
- অবতরণিকা
- অনাগত
- অভ্যূদয়
- স্বপ্ন
- আলো-আঁধারি
- দাদা
- পরভৃত
দ্বিতীয় সর্গ
- শৈশব-লীলা
- প্রত্যাবর্তন
- “সাক্কুস সাদ্র” (হৃদয় উন্মোচন)
- সর্বহারা
তৃতীয় সর্গ
- কৈশোর
- সত্যাগ্রহী মোহাম্মদ
চতুর্থ সর্গ
- শাদী মোবারক
- খদিজা
- সম্প্রদান
- নও কাবা
- সাম্যবাদী