অভেদম্ কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । নতুন চাঁদ কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। প্রকাশক ছদরুল আনাম খান, মোহাম্মদী বুক এজেন্সী, ৮৬এ, লোয়ার সার্কুলার রোড, কলকাতা এতে রয়েছে নজরুলের ১৯টি কবিতা ।
অভেদম্ কবিতা
দেখিয়াছ সেই রূপের কুমারে, গড়িছে যে এই রূপ?
রূপে রূপে হয় রূপায়িত যিনি নিশ্চল নিশ্চুপ!
কেবলই রূপের আবরণে যিনি ঢাকিছেন নিজ কায়া
লুকাতে আপন মাধুরী যে জন কেবলই রচিছে মায়া!
সেই বহুরূপী পরম একাকী এই সৃষ্টির মাঝে
নিষ্কাম হয়ে কীরূপে সতত রত অনন্ত কাজে।
পরম নিত্য হয়ে অনিত্য রূপ নিয়ে এই খেলা
বালুকার ঘর গড়িছে ভাঙিছে সকাল-সন্ধ্যা বেলা।
আমরা সকলে খেলি তারই সাথে, তারই সাথে হাসি কাঁদি
তারই ইঙ্গিতে ‘পরম-আমি’রে শত বন্ধনে বাঁধি।
মোরে ‘আমি’ ভেবে তারে স্বামী বলি দিবাযামী নামি উঠি,
কভু দেখি – আমি তুমি যে অভেদ, কভু প্রভু বলে ছুটি।
একাকী হইয়া একা-একা খেলি, চুপ করে বসে থাকি।
ভালো নাহি লাগে, কেন সাধ জাগে খেলুড়িরে কাছে ডাকি!
সৃষ্টির ঘুড়ি উড়াই শূন্যে, আনন্দে প্রাণ নাচে,
দেখি সে লাটাই লুটায়ে পড়েছে কখন পায়ের কাছে।
বীজ রূপে রই – নিজ রূপ কই? খুঁজিতে সহসা দেখি
সেই বীজ-আমি মহাতরু হয়ে ছড়ায়ে পড়েছি – এ কী!
শাখাপ্রশাখায় পল্লবে-ফুলে ফলে-মূলে কত রূপে
কখন আমারে বিকশিত করি খেলিতেছি চুপে চুপে!
কত সে বিহগ-বিহগী আসিয়া বেঁধেছে আমাতে নীড়,
ঊর্ধ্বে নিম্নে কত অনন্ত আলো আঁধারের ভিড়।
অনন্ত দিকে অনন্ত শাখা, অনন্ত রূপ ধরি
উদ্ভিদ জড় জীব হয়ে আমি ফিরিতেছি সঞ্চরি।
চির-আনমনা উদাসীন, তাই নিজ সৃষ্টিরই মাঝে
হেরি কত শত ছন্দপতন অপূর্ণতা বিরাজে।
চমকি উঠিয়া সংহার করি আপনার সেই ভুল,
সেই ভুল দিয়া নতুন করিয়া ফুটাই সৃষ্টি-ফুল।
মৃত্যু কেমন লাগে মোর কাছে, শোনো সে বাণী অভয়,
আঁখির পলক পড়িলে যেমন ক্ষণিক সৃষ্টি-লয়,
একটি পলক আঁধারে হেরিয়া আবার সৃষ্টি হেরি,
মৃত্যুর পরে জীবন আসিতে ততটুকু হয় দেরি!
মৃত্যুর ভয় ভীত যারা, হয় তাদেরই নরকভোগ,
অমৃতে সেই ডুবে আছে, যার নিত্য আত্ম-যোগ!
মোরই আনন্দ সৃষ্টি করিছে স্ত্রী ও পুত্র আদি,
কেবলই মিলন লাগে নাকো ভালো, বিরহ রচিয়া কাঁদি।
কেবল শান্তি শ্রান্তি আনিলে নিজে অশান্তি আনি,
ভুলিয়া স্বরূপ ঠুলি পরে টানি শত কর্মের ঘানি।
রুদ্রের রূপে সংহার করি, প্রেমময় রূপে কাঁদি,
যারে ‘তুমি’ বল, সেই ‘আমি’ খুঁজি নিজের অন্ত আদি।
সংসারে আসি সং সেজে আমি – শত প্রিয়জন লয়ে,
আপনারে ভোগ করিতে জন্মি বিপুল তৃষ্ণা হয়ে।
যত ভোগ করি তত আপনার তৃষ্ণা বাড়িয়া যায়
অমৃত-মধু মদ হয়ে উঠে তৃষ্ণায় পিয়ালায়!
বন্ধু! কেমনে মিটিবে তৃষ্ণা পূর্ণেরে নাহি পেলে,
আমি যে নিজেই অপূর্ণরূপে এসেছি পূর্ণে ফেলে!
সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার – এই তিন রূপই যাঁর লীলা,
সেই সাগরের আমি যে ঊর্মি, বিরহিণী ঊর্মিলা!
দুখ শোক ব্যাধি নিজে লই সাধি, – কখনও অত্যাচারী-
অসুর সাজিয়া কেড়ে খাই – পুন দেবতা সাজিয়া মারি!
বিদ্বেষ নাই, আসক্তিহীন শুধু সে খেলার ঝোঁকে
অসাম্য করি সৃজন – আবার সংহার করি ওকে।
খেলিতে খেলিতে সহসা চকিতে দেখি আপনারই কায়া
শ্রী ও সামঞ্জস্যবিহীন এ কী কুৎসিত ছায়া!
সেই কুৎসিত শ্রীহীন অসুরে তখনই বধিতে চাই,
মোর বিদ্রোহ সাম্য-সৃষ্টি – নাই সেথা ভেদ নাই।
নাই সেথা যশ তৃষ্ণার লোভ, নাই বিরোধের ক্লেদ,
নাই সেথা মোর হিংসার ভয়, নাই সেথা কোনো ভেদ,
নাই অহিংসা-হিংসা, সেখানে কেবল পরম সাম,
রাজনীতি নাই, কোনো ভীতি নাই, ‘অভেদম্’ তার নাম।
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অ কিঞ্চিত কর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জন প্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্ত র্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- নতুন চাঁদ
- চির-জনমের প্রিয়া
- আমার কবিতা তুমি
- নিরুক্ত
- সে যে আমি
- অভেদম্
- অভয় সুন্দর
- অশ্রু-পুস্পাঞ্জলী
- কিশোর রবি
- কেন জাগাইলি তোরা
- দুর্বার যৌবন
- আর কতদিন
- ওঠ রে চাষী
- মোবারকবাদ
- কৃষকের ঈদ
- চাষীর ঈদ
- আজাদ
- ঈদের চাঁদ
- চাঁদনী রাতে