অনাগত কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । মরুভাস্কর কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। হজরত মোহাম্মদ সঃ এর জীবনী নিয়ে চারটি সর্গে ১৮ টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ।

অনাগত কবিতা
বিশ্ব তখনও ছিল গো স্বপ্নে, বিশ্বের বনমালী
আপনাতে ছিল আপনি মগন। তখনও বিশ্ব-ডালি
ভরিয়া ওঠেনি শস্যে কুসুমে ; তখনও গগন-থালা
পূর্ণ করেনি চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারকার মালা।
আপন জ্যোতির সুধায় বিভোর আপনি জ্যোতির্ময়
একাকী আছিল – ছিল এ নিখিল শূন্যে শূন্যে লয়।
অপ্রকাশ সে মহিমার মাঝে জাগেনি প্রকাশ-ব্যথা,
ছিল নাকো সুখ দুখ আনন্দে সৃষ্টির আকুলতা।
ছিল না বাগান, ছিল বনমালী! – সহসা জাগিল সাধ,
আপনারে লয়ে খেলিতে বিধির, আপনি সাধিতে বাদ।
অটল মহিমা-গিরি-গুহা-ত্যজি– কে বুঝিবে তাঁর লীলা–
বাহিরিয়া এল সৃষ্টি প্রকাশ নির্ঝর গতিশীলা।
ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোমের সৃজিয়া সে লীলা রাজ,
ভাবিল সৃজিবে পুতুলখেলার মানুষ সৃষ্ট-মাঝ।
চলিতে লাগিল কত ভাঙাগড়া সে মহাশিশুর মনে,
মানুষ হইবে রসিক ভ্রমর, সৃষ্টির ফুলবনে।
আদিম মানব ‘আদমে’ সৃজিয়া এক মুঠা মাটি দিয়া
বলিলেন, ‘যাও, করো খেলা ওই ধরার আঙনে গিয়া!’
সৃজিয়া মানব-আত্মা তাহার দানিল মানবদেহে,
কাঁদিতে লাগিল মানব-আত্মা পশিয়া মাটির গেহে।
বলে, ‘প্রভু, আমি রহিতে নারি এ ধূলি-পঙ্কিল ঘরে,
অন্ধকার এ কারাঘরে একা রহিব কেমন করে!’
আদমের মাঝে বারেবারে যায় বারেবারে ফিরে আসে
চারিদিকে ঘোর বিভীষিকা শুধু, কাঁপিয়া মরে সে ত্রাসে।
কহিলেন প্রভু, ‘ভয় নাই, দিনু আমার যা প্রিয়তম
তোমার মাঝারে – জ্বলিবে সে জ্যোতি তোমাতে আমারই সম।
আমা হতে ছিল প্রিয়তর যাহা আমার আলোর আলো
– মোহাম্মদ সে, দিনু তাঁহারেই তোমারে বাসিয়া ভালো!’
মানব-আত্মা পশিয়া এবার আদমের দেহমাঝে
হেরিল তথায় অতুল বিভায় মহাজ্যোতি এক রাজে।
আত্মার আলো ঘুচাতে পারেনি যে মহা অন্ধকার
তারে আলোময় করিয়াছে আসি এ কোন জ্যোতি-পাথার।
বন্দনা করি সে মহাজ্যোতিরে আদম খোদারে কয়,
‘অপরূপ জ্যোতি-প্রদীপ্ত তনু এ কার মহিমময়!
কেবা এ পুরুষ, কেন এ উদিল আমার ললাট-তীরে,
ধন্য করিলে কেন এ মধুর বোঝা দিয়ে মোর শিরে?’
কহিলেন খোদা, ‘এই সে জ্যোতির পূণ্যে আঁধার ধরা
আলোয় আলোয় হবে আলোময়, সকল কলুষ-হরা
এই সে আলোর দীপ্তি ভাতিবে বিশ্ব নিখিল ভরি
এ জ্যোতি-বিভায় হইবে প্রভাত পাপীদের শর্বরী।
আমার হাবিব – বন্ধু এ প্রিয় ; মানব-ত্রাণের লাগি
ইহারে দিলাম তোমাতে – হইতে মানব-দুঃখ-ভাগী।
মোহাম্মদ এ, সুন্দর এ, নিখিল প্রশংসিত,
ইহার কন্ঠে আমার বাণী ও আদেশ হইবে গীত।’
সিজদা করিয়া খোদারে আদম সম্ভ্রম-নত কয়,
‘ধূলির ধরায় যাইতে আমার নাহি আর কোনো ভয়।
আমার মাঝারে জ্বালাইয়া দিলে অনির্বাণ যে দীপ,
পরাইয়া দিলে আমার ললাটে যে মহাজ্যোতির টিপ,
ধরার সকল ভয়েরে ইহারই পূণ্যে করিব জয়,
আমার বংশে জন্মিবে তব বন্ধু মহিমময়!
মোর সাথে হল ধন্য পৃথিবী!’ – মোহাম্মদের নাম
লইয়া পড়িল, ‘সাল্লাল্লাহু আলায়াহিসাল্লাম!’
ধরায় আসিল আদিম মানব-পিতা আদমের সাথ
‘খোদার প্রেরিত’, ‘শেষ বাণী-বাহী’ কাঁদাইয়া জান্নাত।
* * * *
শত শতাব্দী যুগযুগান্ত বহিয়া যায় ফিরে নাহি-আসা স্রোতের প্রায় চলে গেল ‘হাওয়া’, ‘আদম’, ‘শিশ্’ ও ‘নূহ’ নবি – জ্বলিয়া নিভিল কত রবি! চলে গেল ‘ইশা’, ‘মুসা’ ও ‘দাউদ’, ইব্রাহিম’ ফিরদৌসের দূর সাকিম। গেল ‘সুলেমান’, গেল ‘ইউনুস’, গেল ‘ইউসুফ’ রূপকুমার হাসিয়া জীবন-নদীর পার। গেল ‘ইসাহাক’, ‘ইয়াকুব’, গেল ‘জবীহুল্লাহ্ ইসমাইল’ খোদার আদেশ করি হাসিল। এসেছিল যারা খোদার বাণীর দধিয়াল তুতী পাপিয়া পিক বুলবুল শ্যামা ; ভরিয়া দিক যাদের কন্ঠে উঠিয়াছিল গো মহান বিভুর মহিমা গান উড়ে গেল তারা দূর বিমান! ঊর্ধ্বে জাগিয়া রহিলেন ‘ইশা’ অমর, মর্ত্যে ‘খাজাখিজির’ - দুই ধ্রুবতারা দুই সে তীর - ঘোষিতে যেন গো এপারে-ওপারে তাহারই আসার খোশখবর- যাহার আশায় এ-চরাচর আছে তপস্যারত চিরদিন; ঘুরিছে পৃথিবী যার আশে সৌরলোকের চারিপাশে। আদিম-ললাটে ভাতিল যে আলো উষায় পুরব-গগন-প্রায় কোথায় ওগো সে আলো কোথায়! আলোক, আঁধার, জীবন, মৃত্যু, গ্রহ, তারা তারে খুঁজিছে হায় কোথায় ওগো সে আলো কোথায়! খুঁজিছে দৈত্য, দানব, দেবতা, ‘জিন’ পরি, হুর পাগলপ্রায় কোথায় ওগো সে আলো কোথায়! খোঁজে অপ্সর, কিন্নর, খোঁজে গন্ধর্ব ও ফেরেশতায় কোথায় ওগো সে আলো কোথায়! খুঁজিছে রক্ষ যক্ষ পাতালে, খোঁজে মুনি ঋষি ধেয়ানে তায় কোথায় ওগো সে আলো কোথায়! আপনার মাঝে খোঁজে ধরা তারে সাগরে, কাননে মরু-সীমায়, কোথায় ওগো সে আলো কোথায়! খুঁজিছে তাহারে সুখে, আনন্দে, নব সৃষ্টির ঘন ব্যথায়, কোথায় ওগো সে আলো কোথায়! উৎপীড়িতেরা নয়নের জলে নয়ন-কমল ভাসায়ে চায়, কোথায় মুক্তি-দাতা কোথায়! শৃঙ্খলিত ও চির-দাস খোঁজে বন্ধ অন্ধকার কারায় বন্ধ-ছেদন নবি কোথায়! নিপীড়িত মূক নিখিল খুঁজিছে তাহার অসীম স্তব্ধতায়, বজ্র-ঘোষ বাণী কোথায়! শাস্ত্র-আচার-জগদল-শিলা বক্ষে নিশাস রুদ্ধপ্রায় খোঁজে প্রাণ, বিদ্রোহী কোথায়! খুঁজিছে দুখের মৃণালে রক্ত-শতদল শত ক্ষত ব্যথায়, কমল-বিহারী তুমি কোথায়! আদি ও অন্ত যুগযুগান্ত দাঁড়ায়ে তোমার প্রতীক্ষায়, চিরসুন্দর, তুমি কোথায়! বিশ্ব-প্রণব-ওংকার-ধ্বনি অবিশ্রান্ত গাহিয়া যায় – তুমি কোথায়, তুমি কোথায়!
* * * *
ধেয়ান-স্তব্ধ বিশ্ব চমকি মেলে আঁখি –
আরবের মরু আজিকে পাগল হল নাকি?
খুঁজিছে যাহারে কোটি গ্রহ তারা চাঁদ তপন
মরু-মরীচিকা হেরিল কি আজ তার স্বপন?
পেল নাকো খুঁজে সকল দিশির দিশারি যার,
মরুর তপ্ত বালুতে পড়িল চরণ তাঁর!
রৌদ্র-দগ্ধ চির-তাপসিনী তনু-কঠিন
এরই তপস্যা করি কি আরব যাপিল দিন?
বালুকা-ধূসর কেশ এলাইয়া তপ্ত ভাল
তপ্ত আকাশ-তটে ঠেকাইয়া এত সে কাল
ইহার লাগি কি ছিল হতভাগি জাগিয়া রে,
বিশ্ব-মথন অমৃত ধন মাগিয়া রে!
* * * *
দশদিক ছাপি ওঠে আবাহন, ‘ধন্য ধন্য মুত্তালিব!’
তব কনিষ্ঠ পুত্র ধন্য আবদুল্লাহ্ খোশ-নসিব,
ঔরসে যাঁর লভিল জনম বিশ্ব-ভূমান মহামানব,
ধেয়ানে যাহারে ধরিতে না পারি নিখিল ভুবন করে স্তব।
ধন্য গো তুমি ‘আমিনা’ জননী কেমনে জঠরে ধরিলে তায়
যোগী মুনি ঋষি পয়গম্বর গেয়ানে যাহার সীমা না পায়!
ধন্য ধরণি-কেন্দ্র মক্কা নগরী, কাবার পুণ্যে গো
বক্ষে ধরিলে তাঁহারে, যে-জন ধরেনি; অসীম শূন্যে গো
যাঁহারে কেন্দ্র করিয়া সৃষ্টি ঘুরিতেছে নিঃসীম নভে
ধরার কেন্দ্রে আসিবে সে-জন, এও কি গো কভু সম্ভবে!
বিন্দুর রূপে আসিল সিন্ধু, শিশু-রূপ ধরি এল বিরাট!
অসম্ভবের সম্ভাবনায় রাঙিল এশিয়া অস্তপাট!
পূর্বে সূর্য ওঠে চিরদিন, পশ্চিমে আজ উঠিল ওই,
স্বর্গের ফুল ফুটিল সেথায় যে-মরুতে ফোটে বালুকা-খই!
নিখিল-শরণ চরণের লাগি তুই কি আরব এত সে দিন
তপস্যা করি করিলি নিজেরে যেন সে বিরাট-চরণ-চিন!
ধন্য মক্কা, ধন্য আরব, ধন্য এশিয়া পুণ্য দেশ,
তোমাতে আসিল প্রথম নবি গো তোমাতে আসিল নবির শেষ!

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অ কিঞ্চিত কর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জন প্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্ত র্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
প্রথম সর্গ
- অবতরণিকা
- অনাগত
- অভ্যূদয়
- স্বপ্ন
- আলো-আঁধারি
- দাদা
- পরভৃত
দ্বিতীয় সর্গ
- শৈশব-লীলা
- প্রত্যাবর্তন
- “সাক্কুস সাদ্র” (হৃদয় উন্মোচন)
- সর্বহারা
তৃতীয় সর্গ
- কৈশোর
- সত্যাগ্রহী মোহাম্মদ
চতুর্থ সর্গ
- শাদী মোবারক
- খদিজা
- সম্প্রদান
- নও কাবা
- সাম্যবাদী